০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, empty
`

এত এনার্জি ও মেধা! ওরা খায় কী?

-

‘মাংস খেলে মাংস বাড়ে, ঘৃতে বাড়ে বল,
দুগ্ধ খেলে চন্দ্র বাড়ে, শাকে বাড়ে মল।’
খনার আমল থেকে বচনটি প্রচলিত। প্রচলিত বচনটি কত ভয়ঙ্কর টের পেয়েছি অনেক পড়ে। উল্লিখিত বচনে চার খাবারের তিনটিই প্রাণিজ, একটি উদ্ভিজ্জ। গোশত ও বলবীর্য বাড়াতে গিয়ে উঁচু তলার ঐশ্বর্যশালীরা ভীষণ বিপদে আছেন। বিপদের কারণ, এসব খাবার উচ্চ ক্যালরিযুক্ত। উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবারের কারণে দেশের স্কয়ার ইউনাইটেড থেকে শুরু করে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালুর ইত্যাদি বড় বড় হাসপাতালে সমস্যা নিয়ে অস্থির ঐশ্বর্যশালীরা। এসব খাদ্যের কারণে মানুষ এক দিকে মৃত্যুর মুখোমুখি অন্য দিকে কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি পেয়ে পৃথিবীর দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে।

৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ইং কলকাতা মুকুন্দপুর রবীন্দ্রনাথ কার্ডিয়াক হাসপাতালের ডা: কে কে আগরওয়াল জোড়া রিং পরিয়ে, ব্যবস্থাপত্র দিতে দিতে বলেন, ‘প্রাণিজ খাদ্য অনেক খেয়ে ফেলেছেন, বাঁচতে হলে চর্বি, স্নেহ, মিষ্টি অর্থাৎ ননিজাতীয় খাবার বন্ধ করতে হবে। এখন থেকে, পরিমিত পরিমাণ প্লেইন রাইস, আটা, মুড়ি, চিঁড়া, রুটি, বিস্কুট, ডাল, শাকসবজি, চিকেন, ফল-ফলাদি, ননিবিহীন দুধ ও কুসুমবিহীন ডিম খেতে হবে।

কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের ছিন্নমূল ছেলেমেয়েদের ভেতর বিস্ময়কর এনার্জি ও অসাধারণ মেধা দেখেছি। অবাক হয়ে ভাবছি, এত এনার্জি ও মেধা! ওরা খায় কী? খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, আমার বর্তমান খাদ্য তালিকার সাথে অনেকটা মিল রয়েছে কোয়ান্টামদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার। যেমন, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে প্রবেশ করে প্রথমে সবজি খিচুড়ি ও আলুর ঝোল তৎসঙ্গে একটি করে ডিম খেয়েছিলাম। পরেই ছিল রঙ চা। জুমার পর দুপুরের লাঞ্চ। নেয়ামতানের পশ্চিম পাশের সাত-আটটি ডাইনিংজুড়ে কোয়ান্টামের কর্মচারীরা খেতে বসেছেন। আমি আমাদের লোকজন মনে করে পাশের খালি একটি ডাইনিংয়ে বসতে গেলেই ইশারায় জানিয়ে দেয়া হয়, ‘মিনিট দশেক পরে আসেন, আপনাদের খানা এখনো টেবিলে পৌঁছেনি।’

বাইরে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি, যারা খাচ্ছেন তারা কোয়ান্টামেরই শ্রমিক দল। সামনে তরকারি ও ভাতের বল। গল্প করছে আর যার যত ইচ্ছা নিয়ে নিয়ে খাচ্ছে। মাছ, মুরগি, ছাগল-ভেড়াসহ বিভিন্ন খামার, ফ্যাক্টরি পরিচালনা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক বলে জানা যায়। কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেড় হাজারের ঊর্ধ্বে। আমাদের মতো বাইরের মেহমান ছাড়াও প্রতিদিন তিন বেলায় ছয় হাজার লোকের খানার আয়োজন করতে হয়।

নজর যায় কোয়ান্টামদের রসুইঘরের দিকে। নেয়ামতানসংলগ্ন দক্ষিণে রসুইঘর। গ্রামের মেজবানিতে যে আয়োজন সে আয়োজনের চেয়ে বেশি সরগরম কোয়ান্টাদের রসুই ঘরে। মেজবানির আয়োজন এক দিনের জন্য আর কোয়ান্টামদের আয়োজন বছরের পর বছরজুড়ে। সকাল ৭টায় নাশতা রেডি। নাশতার মেনুতে কখনো সবজিভাজি দিয়ে ডাল-ভাত, কখনো খিচুড়ি। সবার জন্য একটি করে সেদ্ধ ডিম। এক তথ্যে প্রকাশ, এক হাজার ৫০০ কোয়ান্টার জন্য প্রতিদিন একটি করে মাসে ৪৫ হাজার আর বছরে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ডিম প্রয়োজন হয়। ডিমের পুরোটাই আসে কোয়ান্টামদের নিজস্ব ফার্ম থেকে। এক হাজার ৫০০ কোয়ান্টাম এবং ৫০০ কর্মীর জন্য সকাল, দুপুর ও রাত মিলিয়ে এই চুলোগুলোতেই প্রতিদিন রান্না হয় ছয় হাজার লোকের খাবার।

দুপুরের আয়োজনে দরকার ২৫০ কেজি চাল, যা একজনের দুই বছরের খাবারের সমপরিমাণ। সবজি ৪৫০ কেজি যা একজনের ছয় বছরের খাবারের সমপরিমাণ, ডাল ২০ কেজি, যা একজনের এক বছরের খাবারের সমপরিমাণ, মাছ ৩২০ কেজি, যা একজনের ১৪ বছরের খাবারের সমপরিমাণ। মাছের জোগান আসে কোয়ান্টামের নিজস্ব খামার থেকে। কোয়ান্টামের নিজস্ব পুকুর আছে ১২টির মতো। যেখানে চাষ হয় পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, রুই, কাতল, মৃগেল প্রভৃতি মাছ।

বছরে উৎপাদন ক্ষমতা ১৮ হাজার ১৪৩ কেজির বেশি। কোয়ান্টামদের দরকার হয় ৩০ হাজার কেজি- যার অর্ধেকের বেশি জোগান দেয় নিজস্ব খামার। গোশতের চাহিদা ৩৯ হাজার ৫২০ কেজি, যার পুরোটাই আসে ব্রয়লার মুরগির খামার থেকে। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাছ, মুরগি, ছাগল ও ভেড়ার খাবারের জন্য রয়েছে নিজস্ব পোলট্রি ফ্যাক্টরিও। কোয়ান্টামদের লেয়ার, ব্রয়লার মুরগিসহ মাছের খাবার তৈরি হয় তাদের ফ্যাক্টরিতেই। এর আরো একটি উদ্দেশ্য, যে প্রাণিসম্পদ থেকে কোয়ান্টামদের পুষ্টি আসবে সেই প্রাণীদের খাবারের মান বজায় রাখা। বাজার থেকে আনতে হয় সবজি।

নানা ধরনের মৌসুমি সবজি কোয়ান্টাদের বাড়ন্ত দেহের কথা মাথায় রেখে কেনা হয়ে থাকে। গড়ে প্রতিদিন ৯১৫ কেজি সবজি প্রয়োজন- মাসে ২৭ হাজার ৪৫০ কেজি। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ দিনে যে পরিমাণ সবজি খাওয়া উচিত সে হিসেবে এ সবজি একজনের ১৫ বছরের খাবারের সমান। শাকসবজিগুলোর বেশির ভাগই সংগ্রহ করতে হয় স্থানীয় কৃষকের কাছ থেকে। কোয়ান্টামে দরকার প্রায় প্রতি বেলাই ভাত বা ভাতজাতীয় খিচুড়ি- তাই চাল দরকার প্রচুর। প্রচুর চাল স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। এক হাজার ৫০০ কোয়ার্টার জন্য প্রতিদিন চাল দরকার হয় ৮৪০ কেজির মতো। চার সদস্যের একটি পরিবার খেতে পারে দেড় বছর। বছরে চালের দরকার হয় ৩০০ টনেরও বেশি। এ বিপুল পরিমাণ চাল সংগ্রহ করতে কর্মীদের কখনো কখনো যেতে হয় রাজশাহী নওগাঁয়ের মতো দূরবর্তী অঞ্চলে। সবজির মতো চালের প্রতিটি চালানও ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয় মান ঠিক আছে কি না। আর খাবারের মান শুধু পরীক্ষা নয়, আবশ্যকও। কারণ একই খাবার খেতে হয় পাঁচ বছরের শিশুকেও।

কোয়ান্টামদের নিজস্ব বেকারির নাম শুকরান। শুকরানে প্রতিদিন ১৯২ প্যাকেট টোস্ট বিস্কুট ছাড়াও ছয়া, পিনাট, কুকিজসহ অর্ডারমাফিক পাউরুটি, বনরুটি, বাটারবান, ডেনিস ইত্যাদি তৈরি হয় বেকারিতে। স্বাদের পাশাপাশি নিজস্ব তত্ত্বাবধানে হওয়ার কারণে মানও নিশ্চিত করা যাচ্ছে ষোলো আনা। এসব কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার শূন্যের কোঠায়।

দুপুরের রান্না সাড়ে ১২টার দিকেই শেষ করতে চায়। দূরের ক্যাম্পাসগুলোতে খাবার চলে যায় রিকশা-ভ্যানে করে। পাহাড়ি পথ, অসমান পাহাড়ি পথ তাতে কী? আছে দক্ষ কর্মী বাহিনী। যে পথ দিয়ে আমরা হাঁটতে গেলে হাঁপিয়ে উঠি- সে পথ দিয়ে এক ক্যাম্পাস থেকে আরেক ক্যাম্পাসে দৌড়ে নিয়ে যায় খাবার ভর্তি রিকশা-ভ্যান।

খাবার পৌঁছাতেই কর্মীরা টেবিলে খাবার সাজাতে শুরু করেন। কারণ কোয়ান্টাদের স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে। আর তা বোঝা যাচ্ছে কোয়ান্টাদের সমবেত কণ্ঠে, ‘আমি পারি, আমি পারব, আমার জীবন আমি গড়ব’ মধুর ধ্বনি থেকেই। নেয়ামতানে খাবারের সব প্রস্তুতি শেষ। আসতে শুরু করেছে কোয়ান্টারাও। প্রত্যেকের টেবিল নির্দিষ্ট করা আছে। কাজেই প্রত্যেকেই জানে কে কোথায় বসতে হবে। ডাইনিংয়ে বসা থেকে শুরু করে, বজ্রাসনে বসা। সবাই একসাথে বসার পর সমবেত প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় খাবার গ্রহণ। এর আগে যত খিদেই থাকুক কেউ কোনো খাবার স্পর্শ করবে না। কঠোর শৃঙ্খল। এ দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

খাবার শেষ, এবার প্লেট ধোয়ার পালা। খাওয়া শেষে এঁটো বাসনপত্র পরিষ্কার করাসহ মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে সারতে হয় ওদের খাবার পর্ব। কসমো স্কুল ও সেন্টার মিলিয়ে প্রতিদিন কোয়ান্টামের পানির চাহিদা প্রায়, ৩০ হাজার লিটার। পানির পুরোটাই আসে ডিপটিউব থেকে। খাবারের বর্জ্যাদি পরিষ্কার করে সবাই চলে যাবে যার যার ইভেন্টে। স্বাস্থ্যকর সব চ্যাম্পিয়ান কোয়ান্টা বছরজুড়ে খায় সব ধরনের মৌসুমি ফল।

এতক্ষণে খাবার সাজানো হয়ে গেছে আমাদের ডাইনিংয়েও। আমাদের লাঞ্চের মেন্যু, সাদা ভাত, আলুভর্তা, সবজি, মুরগি ও ডাল। কলকাতার মুকুন্দপুর বঙ্গবন্ধু কার্ডিয়াক হাসপাতালে গত ডিসেম্বর এক জোড়া রিং বসিয়েছি। চিকিৎসক বাকি জনম খাওয়ার জন্য যে মেন্যু দিয়েছে সে মেন্যু কোয়ান্টামরা আগেই বেছে নিয়েছে। হার্ট, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিস ইত্যাদি প্রাণঘাতী ও কষ্টদায়ক রোগ যেসব কারণে হয়ে থাকে কোয়ান্টাদের খাবার-দাবার ও জীবনযাত্রায় সেসব কারণ অনুপস্থিত বললেই চলে। খাওয়ার পর দুধ-চিনিবিহীন মগভর্তি রঙ চা।

কসমো স্কুলের প্রাইমারি কোয়ান্টাদের এই ডাইনিংয়ে যারা খাচ্ছে তাদের মধ্যে আছে উহাই মং। উহাই মং কসমো স্কুলের উদীয়মান খুদে জিসনেস্ট। উহাই মংয়ের মতো খুদে জিসনেস্টদের বাড়তি এনার্জির জন্য দরকার আরো কিছু বাড়তি খাবার, তাই প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ এক মগ করে সয়ামিল্ক। এ দুধ তৈরি হয় কোয়ান্টামামদের নিজস্ব সয়ামিল্ক ফ্যাক্টরিতে। প্রতিদিন ৩৮০ লিটার ইসোয়ামিল্ক তৈরি হয় এই ফ্যক্টরিতে। যারা স্পোর্টসবয় বা স্পোর্টসগার্ল তাদের জন্যও বাড়তি এনার্জি আবশ্যক হয়। বাড়তি এনার্জির জন্য খাবারের শেষে প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ এক মগ করে ছয়াদুধ। আর এ দুধ তৈরি হয় তাদের নিজস্ব ছয়ামিল্ক ফ্যাক্টরিতে।

নিজস্ব স্বনির্ভর প্রকল্প থেকে বাগানের টাটকা ফল ও সবজি। বছরজুড়ে তরতাজা ভেজালমুক্ত মৌসুমি ফল, যা শহরের শিশুরা ভাবতেই পারে না। রাতের স্কুল শেষ করে ১০টার দিকে যখন আবাসনে ফেরে তখন নাশতা হিসেবে দেয়া হয় ছোলা, বাদামভাজা প্রভৃতি। নিজস্ব হাসপাতাল সাফিয়ানে রয়েছে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা। ভর্তি হওয়ার পরপরই স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরু হয়। সমস্যা থাকলে সারিয়ে নেয়া হয় শুরু থেকেই। বাস করে ধুলাবালু ও দূষণমুক্ত জীবনশক্তিতে ভরপুর সবুজ প্রকৃতির মধ্যখানে।


আরো সংবাদ



premium cement