উল্টানো দৃষ্টি ও অলীক ফোবিয়া
- মুসা আল হাফিজ
- ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৯:১৬
জাতিতে জাতিতে সেতুবন্ধন তৈরি করে বিশ্বায়ন নিশ্চিত করার একালে জাতিতে জাতিতে সঙ্ঘাত এক প্রবল বাস্তবতা। এ সঙ্ঘাতের সবচেয়ে অগ্নিময় ক্ষেত্রটি হয়ে আছে ইসলাম ও পশ্চিমা সভ্যতার সম্পর্ক। পশ্চিমা দুনিয়ায় ইসলামোফোবিয়া এমন এক প্রচণ্ডতা লাভ করেছে, যা এখন সেখানে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার। ইসলামকে দানব বানানোর প্রকল্পে ‘যোদ্ধারা’ এত খেটেছেন, যার প্রভাবে তৈরি হচ্ছে এমন অসংখ্য তরুণ, যাদের স্লোগান হচ্ছে, ‘মুসলিমমুক্ত ইউরোপ ও আমেরিকা’।
এই স্লোগানধারীরা মিডিয়া, শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজবাস্তবতায় এখন খুবই প্রভাবশালী। ইউরোপীয় সমাজের যে বহুত্ব, যে উদারতা, যে মিথস্ক্রিয়া, ইসলামের প্রশ্নে এর বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে লোকরঞ্জনবাদ। এর গোড়ায় আছে গোয়েবলসীয় অপপ্রচার। হিটলারের এ প্রচারমন্ত্রী বলতেন ‘সাদা বেড়ালকে কালো বানিয়ে দাও।’ কিভাবে? ‘যদি সাদা বেড়ালকে অনবরত কালো বলা হতে থাকে, লোকেরা একদিন ঠিকই তাকে কালো বেড়াল ভাবতে শুরু করবে’। ইসলাম নিয়ে ঘটেছে এটাই। অনবরত হিংস্র চেহারা আরোপ করা হয়েছে তার ওপর। দেখানো হয়েছে, পাশ্চাত্যের জন্য ইসলাম এক ভয়াল প্রতিপক্ষ। এটা শত্রুতা ও ধ্বংস ছাড়া কখনো কিছুই দেয়নি। এটা অতীতে যেমন হুমকি ছিল, এখনো ঠিক তাই!
পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীতার প্রধান ধারাটি এই প্রচারণাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। অথচ যদি সত্যকে অনুসন্ধান করা হয়, তাহলে স্পষ্ট হবে, পশ্চিমা দুনিয়ায় ইসলাম ছিল একটি আশীর্বাদ, এক আলো, এক সূর্যোদয়। অন্তত জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব এতই ব্যাপক, যার কিয়দংশ প্রচারিত হলেই পশ্চিমা দুনিয়ায় পথভ্রষ্ট ও হিংস্র ইসলামোফোবিয়া থমকে দাঁড়াত। যে তরুণরা শুনেছে, মুসলিম মানেই বর্বর ও উচ্ছেদযোগ্য প্রতিপক্ষ, সে জানত না মুসলিম মানে, বন্ধু এবং শিক্ষকও। পশ্চিমা দুনিয়ায় এমন বহু সত্যনিষ্ঠ ইতিহাসবিদ ও বুদ্ধিজীবী আছেন, যাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে এ সত্য। কিন্তু পরিকল্পিত ও সঙ্ঘবদ্ধ প্রচারের ডামাডোলে সেই সব কণ্ঠস্বর শোনাই যায় না।
ইসলামোফোবিক তরুণরা যদি সে কণ্ঠস্বর শুনত, তাহলে বুঝত, যে গ্রিক দর্শন, গণিত ও বিজ্ঞানবাদ পশ্চিমা জাগরণের প্রধান হাতিয়ার, মুসলিমরা একে সরবরাহ করেছিলেন ইউরোপকে। অথচ এ মুসলিমদের নাম বাদ দিয়ে এর কৃতিত্ব দেয়া হয় কেবল গ্রিকদের। কিন্তু রবার্ট ব্রিফল্টের মতো ইতিহাসবিদ স্বীকার করেছেন, ‘গ্রিকদের জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতশাস্ত্র ছিল বিদেশ থেকে আমদানি করা। এগুলো গ্রিক সংস্কৃতির সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারেনি। গ্রিকরা পদ্ধতিকরণ, কতগুলো দৃষ্টান্ত থেকে সাধারণ শ্রেণিবদ্ধকরণে নিপুণ ছিল। কিন্তু ধৈর্যসহকারে অনুসন্ধান, নিশ্চিত জ্ঞান আহরণ, দীর্ঘকাল ধরে বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করা সর্বতোভাবে গ্রিক মেজাজের পরিপন্থী ছিল। পুরনোকালে বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম সীমাবদ্ধ ছিল গ্রিক আলেকজান্দ্রিয়াতে। আমরা যাকে বিজ্ঞান বলে আখ্যায়িত করি, তা জিজ্ঞাসু মন, নতুন অনুসন্ধান পদ্ধতি, পরীক্ষণ, নিরীক্ষণ পদ্ধতি এবং গণিতশাস্ত্রের অগ্রগতির ফলে ইউরোপেই বিকাশ লাভ করেছে। সেই মন ও পদ্ধতি ইউরোপকে সরবরাহ করেছিল আরবরা।’
ব্রিফল্টের এ বক্তব্য কেবল তারই নয়, ঐতিহাসিক অসংখ্য সূত্রে সমর্থিত। গুস্তাব লি ভো তার বিখ্যাত ‘লা সিভিলাইজেশন ডেজ অ্যারাবস’ গ্রন্থে স্পষ্টভাবেই লিখেছেন, ‘ইউরোপে বিজ্ঞান জীবন পেয়েছে আরবির মাধ্যমে মুসলিম শিক্ষার প্রভাবেই। আরবরাই ফেরি করেছে বিজ্ঞানচেতনা।’
আরবদের এ বিজ্ঞানচেতনার উৎস কী? অনেকেই এর উৎস খোঁজেন গ্রিক বিজ্ঞানে। এটা আসলে ভুল। মুসলিমদের বিজ্ঞানচেতনার উৎস ইসলামেই নিহিত। ঐতিহাসিক রোমল্যান্ডের বয়ান শুনুন- আল্লাহর সৃষ্ট জগতকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার বাসনা, বস্তুজগতকে আত্মিক জগতের মতোই গুরুত্ব প্রদান, আরব মনের বাস্তবতাবাদ এবং অদম্য কৌতূহল। ইসলামের ধর্ম ও বিজ্ঞান আলাদা পথ ধরে অগ্রসর হয়নি। বস্তুত প্রথমটা দ্বিতীয়টাকে উৎসাহ জুগিয়েছে।
এটা অনস্বীকার্য, মুসলিমরা পাশ্চাত্যের মতো বিজ্ঞানকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেয়নি। বস্তুত ইসলামই বিশ্বকে নিয়ে গবেষণা করার উৎসাহ জুগিয়েছে। খ্রিষ্টান জগতের বিজ্ঞান ও ধর্মের সংঘর্ষ এখানে ছিল না। ধর্মীয় আবেগ নিয়েই বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালানো হতো। এর লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যক্তিদের ইসলামের আস্তিকতা ও গৌরব প্রতিষ্ঠা। ইসলামী বিজ্ঞান তাই কখনও অমানবীয় হয়নি, যেমনটা হয়েছে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান।
ইউরোপীয় ইতিহাসবিদদের অনেকেই অন্যায়ভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের ‘গ্রিকদের শাগরেদ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারা মুসলমানদের বিজ্ঞানচেতনার উৎস হিসেবে গ্রিকদের কৃতিত্ব দেন। বেরণ কারা ডি ভাক্স বিখ্যাত ‘দ্য লিগ্যাসি অব ইসলাম’ গ্রন্থে মুসলমানদের অবদানের কথা স্বীকার করলেও তাদের প্রাচীন গ্রিকদের অনুসরণকারীর অধিক মর্যাদা দেননি। বার্ট্রান্ড রাসেল তার ‘দ্য হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি গ্রন্থে আরবদের বলেছেন- গ্রিক বিজ্ঞানের নিছক বাহক ও অনুবাদক। অনুবাদের মাধ্যমে তারা নাকি কেবল গ্রিক বিজ্ঞানকে ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও ঐতিহাসিক সমীক্ষায় এ তথ্য ভুল বলেই প্রমাণিত। রাসেল নিজেই আবার কবুল করেছেন, আরবদের সময় পর্যন্ত বিজ্ঞান দু’ধারায় বিকাশমান ছিল- ১. আমাদের এর যোগ্য করে তোলা যে, আমরা বস্তুকে জানব; ২. আমাদের বস্তুনিচয় ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা। আর্কিমিডিসের একমাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া গ্রিকদের আকর্ষণ ছিল শুধু প্রথম ধারার প্রতি।
বস্তুত এটা সিদ্ধ সত্য যে, প্রাচীন গ্রিসের যা কিছু কীর্তি-উন্নতি-উৎকর্ষ, তার সবই দর্শন ও শিল্পকলার এলাকাতেই সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের অবদান এতই অপ্রতুল যে, আর্কিমিডিস ছাড়া গ্রিস আর কোনো বৈজ্ঞানিক সন্তান জন্ম দিতে পারেনি। খ্রিষ্টপূর্ব ২২২ অব্দে, শহরতলির বালুকাবেলায় কোনো জটিল জ্যামিতিক সমস্যায় মগ্ন থাকা অবস্থায় এক রোমান সৈন্য হত্যা করেছিল তাকে। খ্রিষ্টপূর্ব সমগ্র পাশ্চাত্যে প্রবল প্রতাপ নিয়ে রোম ছিল এক সমৃদ্ধ সভ্যতা। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস অনুসন্ধানকারীদের কাছে রোম এক অন্ধকার এলাকারও নাম। সমরবিদ্যা ও এর প্রয়োগ সাধনে তারা লাভ করেছিলেন উন্নতি। এ ছাড়া গ্রিকদের বিপুল জ্ঞানের উত্তরাধিকার তারা পেয়েছিলেন সরাসরি ও সহজে। কিন্তু এর পরও রোমান সভ্যতা তার হাজার বছরের আয়ুষ্কালে একজন বিজ্ঞানীর জন্ম দিতে পারেনি।
এরপর উদয় হলো ইসলামী সভ্যতার। শত শত বৈজ্ঞানিক সন্তান জন্ম দেয় এই সভ্যতা।
ব্রিফল্ট স্পষ্ট করেছেন- প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং চেতনায় ইউরোপে আমরা যাকে ‘বিজ্ঞান’ বলে জানি, বিজ্ঞানে অনুসন্ধানের সেই নবচেতনা, নতুন পরীক্ষাপদ্ধতি, পর্যবেক্ষণ এবং অঙ্ক শাস্ত্রের উন্নয়ন, পরিমাপ পদ্ধতি প্রভৃতি গ্রিকদের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। ইউরোপে এই নবচেতনা ও পদ্ধতি আরবরাই প্রবর্তন করেছিল।
আরব দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের মাধ্যমেই গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমৃদ্ধ সম্পদ আধুনিক যুক্তিবাদের জনকদের কাছে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথিকৃৎ রজার বেকনের হাতে পৌঁছেছিল। বেকন তাদেরই অনুগামী ছিলেন। আলেকজান্ডার ভন হামবোল্টের মতে, ‘মুসলিমরা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সত্যিকার জনক হিসেবে আখ্যায়িত হবেন। বর্তমানে এ সত্য স্বীকার করে নিতে আমরা অভ্যস্ত’।
‘আজকের জগতকে রূপান্তরিত করেছে সেই মুসলিম গবেষণাপদ্ধতি, যা ইউরোপে প্রবেশ করেছে। মুসলিমরা অনুসন্ধানের নতুন নতুন ক্ষেত্র খুলেছে। তারা ধৈর্য, সাহস, মুক্তমন এবং বাস্তবমুখী প্রজ্ঞা নিয়ে অগ্রসর হয়েছে।’
কলাবিজ্ঞানের কর্ষণে মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রতিটি শহর অন্য শহরকে অতিক্রম করার চেষ্টা করত। প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও প্রধানরা সুলতানের পদাঙ্ক অনুসরণ করতেন। হাজার হাজার মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাণী শ্রবণের জন্য কর্ডোভা, বাগদাদ ও কায়রোতে ভিড় জমাত। এমনকি খ্রিষ্টানরা ইউরোপে প্রত্যন্ত সীমা থেকে মুসলমানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জ্ঞান লাভের জন্য আসতেন।
এভাবে ইসলামী সভ্যতার আলো সিসিলি, স্পেন হয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ইউরোপজুড়ে। ধীরে ধীরে ‘এজ অব ডার্কনেস’ বা অন্ধকার কাল থেকে জেগে উঠল ইউরোপ। পশ্চিম ইউরোপের জ্ঞানপিপাসু ও বিদ্যানুরাগীরা এই সময়ে স্পেনের বিদ্যালয়গুলোতে এসে সমবেত হতে থাকে। স্পেনের মুসলমানদের প্রতিবেশী হিসেবে আরবিভাষী খ্রিষ্টান ‘মুজারাব’রা ইউরোপে মুসলিম বিজ্ঞানের হস্তান্তর ও প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদের তুলনায় তারা অধিকতর প্রভাবিত হয়েছিল। অগ্রসর খ্রিষ্টান তরুণরা তাদের নিজেদের ভাষার চেয়ে আরবি ভাষায় অধিকতর দক্ষতা ও শুদ্ধতার সাথে মত প্রকাশ করতে পারত।
‘কর্ডোভার আলভারো মুসলিম বিদ্যাচর্চার প্রতি আগ্রহের জন্য তাদের বিরুদ্ধে তিক্তভাবে অভিযোগ আনে। Haisterbach এর Cassar খ্রিষ্টান তরুণদের সম্পর্কে বলেন, তারা জ্যোতিষতত্ত্ব সম্পর্কে অধ্যয়নের জন্য টলেডোতে গিয়েছিলেন। সেন্ট ভিক্টরের হগ মুসলিম দর্শনের প্রতি অধিক আগ্রহের জন্য সেভিলের বিশপকে ভর্ৎসনা করেছিলেন। (এস এম ইমামুদ্দিন- কালচারাল হিস্ট্রি অব মুসলিম স্পেন পৃষ্ঠা-১৮৭) আরব বিজ্ঞান লাতিন ভাষায় অনুবাদ ও আরবি-লাতিন শিক্ষাবিস্তারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। স্পেনের টলেডো ও সেভিলের আরবি-লাতিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরব বিজ্ঞান ইউরোপে বিস্তার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্যালেন্সিয়া, স্লামাঙ্কা এবং লেরিডা বিশ্ববিদ্যালয় যথাক্রমে ১২১৪ ও ১২১৫ সালের অষ্টম আলফন্সো এবং ১৩০০ সালে নবম জায়েমি প্রতিষ্ঠা করেন।
১২৫৪ সালে সেভিলে আরবি-লাতিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন দশম আলফন্সো। টলেডোতেও প্রতিষ্ঠিত হয় অনুরূপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যাতে ছিল সমৃদ্ধ অনুবাদকেন্দ্র। মুসলিম পণ্ডিতদের বিজ্ঞানকে ইউরোপে সম্প্রচারের ক্ষেত্রে টলেডো পালন করেছিল মূল ভূমিকা। এতে আরবিভাষী বহু মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিষ্টান পণ্ডিত নিয়োজিত ছিলেন। ১৫৫৪ সালে দশম আলফন্সো মুহাম্মদ আল রিকোতির মাধ্যমে মার্সিয়া ও সেভিলে প্রতিষ্ঠা করেন আরবি-লাতিন বিশ্ববিদ্যালয়। এতে মুসলিম বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্য পড়ানো হতো। দশম শতকে ইউরোপ আরবমেধার ছায়া গ্রহণ করতে শুরু করে। ইউরোপে তখন মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রধান প্রচারক সিলভেস্টার এর পোপ গার্বেট (মৃত্যু ১০০৩ খ্রি.) আরবদের জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, দর্শন ইত্যাদিতে পারদর্শী হন স্পেনের মাদরাসায়। ইউরোপে রোমক সংখ্যানির্দেশক জটিল চিহ্নের পরিবর্তে আরবি সংখ্যানির্দেশক চিহ্ন প্রবর্তন করেছেন তিনি।
একাদশ শতকে কনস্টান্টিনাস আফ্রিকানাস ইউরোপে ছড়াতে থাকেন ‘মুসলিম বিজ্ঞান’। মুসলিম বিশ্বে তিনি ৩০ বছর ভ্রমণ করে সংগ্রহ করেছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাঠ ও গ্রন্থাবলি। ইউরোপে ফিরে স্যালেরনোতে মুসলিমদের অনুকরণে প্রতিষ্ঠা করেন মেডিক্যাল কলেজ আর লাতিন ভাষায় অনুবাদ করতে থাকেন আরবি থেকে। গড়ে তোলেন অনুবাদের একটি প্রতিষ্ঠান। ১১৩৫ থেকে ১২৮৪ সাল অবধি এখান থেকে জন্ম নিয়েছেন অসংখ্য অনুবাদক ও প্রচারক। তাদের প্রধান কাজ ছিল আরবীয় বিজ্ঞানকে ইউরোপীয় বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এর শিক্ষাদান।
বিভিন্ন কারণে এই সময় অনেক মুসলমানও ইউরোপ গিয়েছিলেন। সভ্যতা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানরা অনেক অগ্রসর-ইউরোপ এটা বুঝেছিল এই যোগাযোগের ফলে। তারপর যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রগামিতা ও চিত্তের মুক্তির প্রয়োজন উপলব্ধি করতে পারে, লাতিন ভাষায় মুসলিম গ্রন্থসম্ভার অনুবাদ করে মুসলমানদের সাথে সংযোগকে তারা আরো প্রগাঢ় ও পরিণতিমুখী করে তোলেন। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকায় লেখা হয়েছে, ‘এই সময় মুসলমানদের কাছে লক্ষাধিক গ্রন্থ সমৃদ্ধ বহু পাঠাগার ছিল।’
অনুবাদের মাধ্যমে এগুলো ইউরোপের হাতে চলে যেতে থাকে। বিশপ রেমন্ডের ধারাবাহিকতায় বাথের এডেলার্ড, ক্রিমোনার জেরার্ড, সেভিলের যোহন, ডমিনিকো গঞ্জালেস, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের মাইকেল স্কট, চেস্টারের রবার্ট, তিভোলির ইতালীয় প্লেটো, মাইকেল স্কোটাস, হারমানাস টিউলোনিকাস প্রমুখের হাত দিয়ে ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, আল বেরুনি, জাহরাভি, খাওয়ারিজমিদের গ্রন্থাবলি ইউরোপে ভাষান্তরিত হয়। বইগুলো ছড়িয়ে পড়ে ইতালি, জার্মানি, মধ্য ইউরোপ ও ব্রিটেনে। মিরাবিলিস নির্দেশ দেন, খ্রিষ্টান স্কুলগুলো ত্যাগ করে শিক্ষার্থীরা যেন আরবি বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়। এর ফলাফল হলো সুদূরপ্রসারী।
ইউরোপে তৈরি হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ একটি প্রজন্ম, যাদের মধ্যে শুধু ফ্রান্সিস বেকন ও রজার বেকন ছিলেন না, ছিলেন সেকালের ‘আলোকময়’ বেশির ভাগ প্রতিভা। তাদের অনুবাদ, রচনা ও আন্দোলন বুদ্ধিবৃত্তিক ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের তরঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চার দিকে। ইউরোপে রেনেসাঁ সংগঠনের পেছনে এরাই ছিল সক্রিয় বারুদ। ফরাসি বুদ্ধিজীবী গুস্তাবলি বা, ঐতিহাসিক রবার্ট ব্রিফল্ট, ডি এইচ রবার্টস, মান্টোগোমারির মতো সত্যসন্ধ গবেষকরা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, আরবদের গবেষণা ও আবিষ্কারের বদৌলতেই বিজ্ঞানময় আধুনিক যুগের সূচনা ইউরোপ করতে পেরেছিল।
জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ মুসলিমদের এমন বহু বিষয় আছে, যার গৌরবময় উত্তরাধিকার বহন করছে পাশ্চাত্য। কিন্তু এটাকে গভীর যতেœ আড়াল করা হয়েছে, দেখানো হয়েছে বিপরীত চিত্র। তা তৈরি করেছে পশ্চিমের উল্টো চোখ, উল্টো মন। ফলে ঘৃণা ও সঙ্ঘাতের আগুন ঢুকে পড়েছে অনেক গভীরে, যা থেকে বেরিয়ে আসা পশ্চিমা দুনিয়ার নিজের প্রয়োজনেই আজ জরুরি।
লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা