কাশ্মিরি বোনদের মর্যাদা
- হামিদ মীর
- ৩০ নভেম্বর ২০১৯, ২০:১২
ফাতেমা ক্রমাগত কেঁদে যাচ্ছে। বলবিন্দর সিং বারবার তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছিলেন, ‘নিজেকে সামলাও। যা বলতে এসেছ, তা বলে ফেল। ভাইজান বেশ ব্যস্ত মানুষ। তুমি পুরো সময়টা কেঁদে নষ্ট করে ফেলছ।’ আমি পানির বোতল খুলে ফাতেমার দিকে বাড়িয়ে ধরলাম। বললাম, ‘একটু পানি পান করুন।’ ফাতেমা পানি পান করলেন। এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে খাঁটি কাশ্মিরি ভঙ্গিতে উর্দু-ইংরেজি মিশেলে বলতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, বড় আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনাকে ধন্যবাদ, আপনি আমাদের সময় দিয়েছেন। মাফ করবেন, আমরা আপনার সাথে আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করতে চাপাচাপি করেছি। যদি ব্যস্ততার কথা বলে আমাদের সময় না দিতেন, আমরা কিছুই করতে পারতাম না।
ফাতেমা ও বলবিন্দরের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে অজিতের মাধ্যমে। লন্ডনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বাইরে অধিকৃত কাশ্মির ও আজাদ কাশ্মিরের মানুষদের সাথে জিও নিউজের জন্য একটি প্রোগ্রামের রেকর্ডিংয়ের পরে ম্যানচেস্টারের পার্লামেন্ট সদস্য আফজাল খানকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছিলাম। এ সময় প্যান্ট-শার্ট পরিহিতা এক তরুণী কানে কানে কথা বলার ভঙ্গিতে আমাকে ‘হ্যালো’ বললেন। এরপর পাঞ্জাবি ভাষায় তিনি বললেন, আমার এক বন্ধু শ্রীনগরের মানুষ। তিনি আপনার সাথে একটু দেখা করতে চান। বললাম, আপনার বন্ধু কোথায়? তরুণী বললেন, বন্ধু এখানে আসতে পারবেন না। কিছুটা সমস্যা আছে। আপনার কাছে অনুরোধ, আজ সন্ধ্যায় সাক্ষাতের সময় দিন। অনুমান করলাম, মেয়েটির শব্দচয়ন বলছে, এ মেয়েটি হিন্দু বা শিখ হবে। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কে?
তিনি বললেন, আমি অজিত। পরে জানলাম, অজিত মেয়েটি শিখ। তিনি বারবার দূরে দাঁড়িয়ে থাকা গুরচরণ সিংয়ের দিকে তাকাচ্ছিলেন এবং তার নজরে পড়া থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি গুরচরণকে চেনেন? অজিত বললেন, গুরচরণজি আমার বড় ভাই বলবিন্দরের বন্ধু। তিনি আপনার প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। তার পেছনে ভারত সরকার অনেক গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছে। এ কারণেই আমার কাশ্মিরি বন্ধু আপনার সাথে এখানে সাক্ষাৎ করবেন না। কেননা গুরচরণ ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎকারীদের ভিডিও ও ছবি তুলে তাদের পরিচয় খুঁজে বের করা হয়। এ সময় আমার বন্ধু তার পরিচয় গোপন রাখতে চাচ্ছেন।
কেননা, তার পরিবার স্বদেশে বেশ কঠিন পরিস্থিতির শিকার। অজিতকে বললাম, আজ সন্ধ্যায় ব্যস্ত থাকব। কাল সকালে আমার হোটেলে চলে আসুন। অজিত দুই হাত জোড় করে বললেন, আপনি খারাপভাবে নেবেন না, আমরা হোটেলেও সাক্ষাৎ করতে পারব না। কেননা আমরা জানি, এখানে আপনার ওপরও বহু লোক নজর রাখছেন। তিনি আমাকে অক্সফোর্ড স্ট্রিটের একটি ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টের ঠিকানা দিলেন। পরের দিন সকাল ১০টায় সেখানে সাক্ষাতের সময় চূড়ান্ত হলো।
পরের দিন নির্দিষ্ট স্থানে অজিত তার বান্ধবী কাশ্মিরি কন্যার সাথে এলেন, তখন সাথে এক লম্বা দীর্ঘদেহী শিখ যুবকও ছিলেন। তিনি বলবিন্দর, অজিতের বড় ভাই। এই কাশ্মিরি মেয়ে আমাকে তার যে নাম বলল, তা পুরোটা লিখছি না, শুধু নামের একাংশ ‘ফাতেমা’ লিখছি। ফাতেমা ও বলবিন্দরকে আমার পাশে বসিয়ে অজিত আমাদের জন্য চা-পানির অর্ডার দিলেন এবং রেস্টুরেন্টের বাইরে গিয়ে বসলেন। আমাদের সাক্ষাৎ শুরু হলে ফাতেমা কাঁদতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে তিনি টিস্যু পেপার দিয়ে চোখের পানি মুছে আমাকে তার কাহিনী শোনাতে শুরু করলেন। ফাতেমার বাবা শ্রীনগরে শালের ব্যবসা করতেন।
কয়েক বছর আগে ফাতেমা উচ্চশিক্ষার জন্য দিল্লির এক কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যান। তার বাবা দিল্লিতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। তিনি মেয়ের সাথে দিল্লি এসে এখানে কাশ্মিরি শালের ব্যবসা প্রসারের চেষ্টা করেন। দুই বছর পর ফাতেমার আরেক বোনও দিল্লিতে ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলে ফাতেমার বাকি দুই বোন ও মা-ও দিল্লি চলে আসেন।
ফাতেমা আইনে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ব্রিটেন এসেছেন। ৫ আগস্ট ভারত সরকার জম্মু-কাশ্মির রাজ্যে কারফিউ জারি করার দিন ফাতেমার বাবা শ্রীনগরে এবং দুই বোন মায়ের সাথে দিল্লিতে ছিলেন। ফাতেমা ও তার পরিবারের তার বাবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ সময় দিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে কাশ্মিরিদের ওপর হামলা শুরু হয় এবং কাশ্মিরি নারীদের গ্রেফতার করার ঘটনাও ঘটতে থাকে। দিল্লিতে অধ্যয়নরত বহু কাশ্মিরি ছাত্রীর পরিবারের সাথে তাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ফাতেমার এক কাজিন ও বান্ধবী শ্রীনগরের। তারা উভয়েই দিল্লির এক হোটেলে থাকতেন। দিল্লিতে হিন্দু ছেলেরা কাশ্মিরি মেয়েদের ধরে নিয়ে যেতে শুরু করলে ফাতেমার কাজিন ও বান্ধবী তার বোনদের কাছে চলে আসেন।
এখন একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে চারজন তরুণী ও একজন বয়স্ক মহিলা আছেন, যারা দিনরাত শ্রীনগরে তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগের জন্য মরিয়া হয়ে এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন। কিছু দিনের মধ্যে তাদের সবার অস্থিরতা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। আরএসএসের সন্ত্রাসীরা এই নিরস্ত্র মেয়েদের ভয় দেখাতে ও হুমকি দেয়া শুরু করে। পরের সপ্তাহে ফাতেমার বাবা কোনোভাবে দিল্লি ফিরে আসেন। তিনি তার ফ্ল্যাটে অবস্থানরত চারজন যুবতী মেয়ের ইজ্জত রক্ষার জন্য দুবাইয়ে অবস্থানরত তার বন্ধু জাফর নায়েকের সাথে যোগাযোগ করেন।
জাফর ওই মেয়েদের উপসাগরীয় আরেক দেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন, কিন্তু এ সময় তার ফোন বন্ধ হয়ে যায়। ফাতেমা বলছিলেন, দু’দিন আগে দিল্লিতে তার বোনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ওই সময় ফাতেমার বাবা জাফর নায়েকের কথা আমার কলামে (ফোঁপানো কান্না শিরোনামে ৮ সেপ্টেম্বর নয়া দিগন্তে প্রকাশিত) পড়ে আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু চেষ্টা সফল হয়নি। এরপর তিনি জানতে পারেন, আমি ব্রিটেনে এসেছি। তখন তিনি ফাতেমাকে বলেন, যেকোনোভাবে হামিদ মীরের কাছে পৌঁছাও এবং জাফর নায়েকের সাথে যোগাযোগের জন্য সহায়তা চাও। ফাতেমা বললেন, এখন আমার বাবা ও বাকি পরিবারকে বলবিন্দর ভাইয়ের চাচা জলন্ধরে তাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে রেখেছেন। জাফর নায়েকের ফোন নম্বর দরকার আমাদের।
ফাতেমাকে বললাম, জাফর দুই সপ্তাহ আগে দুবাই ছেড়ে দোহা চলে গেছেন। তার নম্বর পরিবর্তন হয়েছে। শরীরটাও ভালো নেই। যা হোক, বেশ চেষ্টাচরিত্র করার পর নায়েককে খুঁজে বের করলাম। তিনি অসুস্থ। তিনি ফাতেমার সাথে ফোনে কথা বললেন। বললেন, ‘অসুস্থতার কারণে আপনার বাবার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। আজই যোগাযোগ করব এবং আপনার বোনদের দোহা আনব।’ এরপর ফাতেমা তার বাবাকেও এ সুসংবাদ শোনান। এখন তার চোখে আনন্দের অশ্র“। মনে হচ্ছিল, তিনি সব কিছু পেয়ে গেছেন। বিদায়ের সময় বলবিন্দর সিং আমাকে বললেন, আমরা সবাই মিলে চারজন কাশ্মিরি কন্যার ইজ্জত তো বাঁচালাম, কিন্তু হাজার হাজার লাখ লাখ কাশ্মিরি বোনের ইজ্জত আজ সঙ্কটাপন্ন। আপনার প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, প্রতি জুমায় আধা ঘণ্টা করে ভারতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করুন। এভাবে কি কাশ্মিরি বোনদের ইজ্জত রক্ষা করা যাবে?
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)
দৈনিক জং থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা