২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

‘ওলিদের বেহেশত’ আবারো মহাসঙ্কটে

-

কাশ্মিরকে ‘জান্নাতুল আওলিয়া’ বা ওলিদের বেহেশত বলা হয়। শ্রীনগর থেকে মুজাফফরাবাদ পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মিরের শহরে শহরে, গ্রামে গ্রামে আওলিয়া-মাশায়েখের অসংখ্য মাজার নজরে পড়ে। এ অঞ্চলে ইসলাম তরবারি দিয়ে নয়, বরং জম্মুর হজরত বুলবুল শাহ রহ., সায়্যিদ মীর আলী হামাদানী রহ., শায়খ নুরুদ্দীন ওলি রহ., শায়খ শামসুদ্দীন ইরাকি রহ. ও হজরত বাবা জিউন শাহ রহ.-এর মতো সুফিদের শিক্ষার মাধ্যমে ছড়িয়েছে। এটা সেই অঞ্চল, যেখানে অধিকৃত অঞ্চলে লিল্লাহ আরেফা রহ. ও হাব্বা খাতুন রহ.-এর মতো নারী সুফিদের কবিতা আজো মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। আজাদ কাশ্মিরে হজরত মায়ী উম্মী রহ. ও হজরত মায়ী তুতী সাহেবা রহ.-এর মাজারে ভক্তদের ভিড় এ কথা বলার জন্য যথেষ্ট যে, এখানে নারীদের বেশ সম্মান করা হয়। এখন অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে কাশ্মিরি নারীদের প্রতিদিনের লাঞ্ছনায় লিল্লাহ আরেফা রহ.-এর আত্মা প্রতিনিয়ত হয়তোবা তড়পাচ্ছে। আর হাব্বা খাতুন রহ.-এর হয়তোবা ওই ধোঁকা স্মরণে আসবে, যা সম্রাট আকবর তার স্বামী ইউসুফ শাহ চকের সাথে করেছিলেন। আকবর যখনই কাশ্মির দখল করার চেষ্টা করেছেন, তখনই কাশ্মিরের শাসক ইউসুফ শাহ তার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছেন। অবশেষে আকবর তার কাছে সন্ধির পয়গাম প্রেরণ করেন এবং সাক্ষাতের জন্য তাকে দিল্লি ডেকে পাঠান। চকের সহধর্মিণী হাব্বা খাতুন রহ. কবি ছিলেন। তিনি স্বামীকে দিল্লি যেতে বাধা প্রদান করেন। কিন্তু ইউসুফ শাহ চক মোগল বাদশাহর সম্মানে দিল্লি গেলেন। হাব্বা খাতুন রহ.-এর সন্দেহ বাস্তবে পরিণত হয়। আকবর তার স্বামীকে গ্রেফতার এবং বিহারের এক জেলে বন্দী করেন। স্বামী বন্দী হওয়ার পর হাব্বা খাতুন রহ. বেশ বেদনাদায়ক কবিতা রচনা করেন। তিনি নিজেই এটা গাইতেন। ওই ধোঁকা দিল্লির ক্ষমতাধররা আরো একবার ওই কাশ্মিরিদের সাথে করলেন, যারা দিল্লির শাসকদের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। ৫ আগস্ট, ২০১৯-এর পর থেকে দিল্লি পুরো জম্মু-কাশ্মির রাজ্যকে বন্দী করে রেখেছে। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত আট লক্ষ ভারতীয় সেনা কাশ্মিরি মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করতে ওঁৎ পেতে আছে। আর এ জন্য পাকিস্তান সরকার অধিকৃত এলাকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুকরিয়ার বিষয়, আমাদের সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে চরম রাজনৈতিক বিরোধ সত্ত্বেও অন্তত কাশ্মির সমস্যায় একে অপরের সাথে সহযোগিতা করছে। বিরোধী দলকে আস্থায় এনে সরকার কাশ্মির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

এ দিকটা উপেক্ষা করার মতো নয় যে, বর্তমানে পাকিস্তান তার ইতিহাসের খুবই মারাত্মক অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে সময় পার করছে। এক দিকে পাকিস্তান আইএমএফ-এর সামনে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, অপরদিকে পাকিস্তানের মাথার ওপর এফএটিএফ-এর তরবারি ঝুলছে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বান করতে সফল হয়েছে। এর পাঁচ সদস্যের তিনটিই বৈঠক চলাকালে পাকিস্তানের অবস্থানকে সমর্থন করেছে। তারপরেও ঘোষণা জারি থেকে বিরত থাকা হয়েছে। সাধারণ ধারণা হচ্ছে, এ বৈঠক আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে চীন। চীন বাস্তবিকই এ বৈঠকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আদায় করেছে, কিন্তু রাশিয়া ও ব্রিটেনের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রাশিয়া তার চিরাচরিত অবস্থান থেকে সরে এসে এ বৈঠক আয়োজনের বিরোধিতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে এবং বৈঠকে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবাবলির উল্লেখ করে ফ্রান্সকে হয়রান করে দিয়েছে, যে এ বৈঠকে লড়াই করছিল ভারতের পক্ষে। ব্রিটেন এ বৈঠকে দাবি করেছে, অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তের প্রয়োজন। এটা বলা যথেষ্ট নয় যে, নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে চীন ব্যতীত রাশিয়া ও ব্রিটেনের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের অবস্থানকে সমর্থন জানানো মূলত পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির সফলতা। নিঃসন্দেহে পররাষ্ট্র দফতরও বেশ পরিশ্রম করেছে, তবে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাকিস্তানি ও কাশ্মিরিদের বিক্ষোভও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আর এ কারণে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধি পাকিস্তানের পক্ষে যেমন ঝুঁকেননি, তেমনি ঝুঁকেননি ভারতের দিকেও।

তিনি ২৭ জুন অস্ত্র বিরতি রেখা ভেঙে ফেলার তারিখ ঘোষণা করেছিলেন। তাকে থামানোর অনেক চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি পিছপা হননি। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ফলে রাওয়ালপিন্ডি থেকে মুজাফফরাবাদ পর্যন্ত কয়েক দিন বিক্ষোভ চলে। ৩০ জুন, ১৯৫৮ সালে লাহোরে এক বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সরকার গোলাম আব্বাসকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এক দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুন ভারতের আগ্রাসী আক্রমণের মুখোমুখি অবস্থান করছিলেন, অপরদিকে চৌধুরি গোলাম আব্বাস অস্ত্রবিরতি রেখা ভাঙতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। ১৯৯২ সালের ফেব্র“য়ারিতে জেকেএলএফ ‘অস্ত্র বিরতি রেখা’ ভাঙার কথা ঘোষণা করেছিল, যা এখন ‘নিয়ন্ত্রণ রেখা’ হয়েছে। আরো একবার পাকিস্তান সরকার ও কাশ্মিরি জনগণ মুখোমুখি হওয়ায় অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। এবারের ১৫ আগস্ট আজাদ কাশ্মিরের প্রধানমন্ত্রী রাজা ফারুক হায়দার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মুজাফফরাবাদে অবস্থানকালে নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করার ইঙ্গিত প্রদান করেন। ফারুক হায়দার মূলত আজাদ কাশ্মিরের সাধারণ জনমতের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন, কেননা কাশ্মিরিদের একটি বিশাল অংশ মনে করে, যদি পাকিস্তান ও ভারত আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা নিরসন করতে না পারে এবং জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবও কোনো প্রভাব ফেলতে না পারে, তাহলে তারা নিজেরাই এ সীমান্তকে ‘মুছে দেবে’, যা কাশ্মিরকে ভাগ করে রেখেছে। আওলিয়ায়ে কেরামের ভূখণ্ডকে আরো রক্তপাত থেকে বাঁচানো শুধু পাকিস্তানের নয়, বরং সারা বিশ্বের দায়িত্ব। যদি ভারত অধিকৃত অঞ্চলে নির্যাতন বন্ধ না করে, তাহলে আবারো আজাদ কাশ্মির ও পাকিস্তানের জনগণ নিয়ন্ত্রণরেখাকে নিজেদের রক্তে লাল করতে পিছপা হবে না।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২২ আগস্ট সংখ্যা থেকে ভাষান্তর করেছেন ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement