২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সাদাকাতুল ফিতর : আর্থসামাজিক গুরুত্ব

- ছবি : সংগৃহীত

সাদাকাতুল ফিতর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে, রোজা শেষে, ঈদুল ফিতরের সুবহে সাদিকের সময় গরিবের আনন্দের জন্য নির্ধারিত পরিমাণ খাদ্যপণ্য অথবা অর্থ প্রদান করার জন্য, ইসলাম নির্ধারিত বিশেষ ব্যবস্থা। সামর্থ্যবান, জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশকীয় সামগ্রী ছাড়া নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকদের পক্ষ থেকে, গরিবদের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ প্রদান করাই মূলত সাদাকাতুল ফিতর, যা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর ওয়াজিব। রোজা না রাখলে অথবা রাখতে না পারলেও তার ওপর ফিতরা দেয়া ওয়াজিব।

ফিতরা ওয়াজিব করা হয়েছে- প্রথমত রোজাদারদের জন্য রোজার রাখার ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকলে তার এক ধরনের ক্ষতিপূরণ বা কাফফারা হিসেবে। দ্বিতীয়ত অসহায় মিসকিনদের জন্য ঈদের রিজিকের ব্যবস্থা করার জন্য, যাতে তারাও সবার সাথে আনন্দ উপভোগ করতে পারে। অসহায়, গরিব-মিসকিন যারা জাকাত পাওয়ার যোগ্য, তারাই ফিতরার হকদার। রাসূল সা: রোজা ফরজ হওয়ার বছরেই, জাকাত ফরজ হওয়ার আগে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে জাকাতের মতো এ ক্ষেত্রে এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া জরুরি নয়। বরং কেউ যদি ঈদের আগের দিনও নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাকেও ফিতরা আদায় করতে হবে।
নিজের এবং নিজের অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান, এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক অধীনস্থ সন্তানদের জন্যও ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব।

সন্তানের নামে সম্পদ থাকলে সেখান থেকেও ফিতরা আদায় করা যাবে। কোনো এতিম শিশুর ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে থাকলে তার পক্ষ থেকেও আদায় করা ওয়াজিব। রাসূলুল্লাহ সা: স্বীয় উম্মতের ক্রীতদাস ও স্বাধীন, নারী ও পুরুষ, ছোট ও বড় সবার ওপর ফিতরা ওয়াজিব করেছেন এবং তা ঈদের দিন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগেই আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। এমন কি, ঈদের দিন সকালে কোনো শিশু ভূমিষ্ঠ হলে তার পক্ষ থেকেও ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। অর্থাৎ, সাদাকাতুল ফিতর হলো জানের সদকা, মালের নয়; তাই জীবিত সব মুসলিমের জানের সদকা আদায় করার জন্যই ফিতরার ব্যবস্থা।

ফিতরা প্রদানের ক্ষেত্রে পরিবারের কয়েকজনের সদকা মিলিয়ে একজন গরিবকে একসাথে দেয়া যেতে পারে; অথবা একজনের সদকা কয়েকজন গরিবকেও দেয়া যেতে পারে। তবে অধিকতর উত্তম হলো, একজন গরিবকে এই পরিমাণ ফিতরা দেয়া, যা দিয়ে সে তার ছোটখাটো প্রয়োজন পূরণ করতে পারে কিংবা দু’-তিন বেলা খেতে পারে। ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম। তবে জাকাতের মতো সে সময়ের আগেও আদায় করা যায়। আবার কোনো কারণে সময় মতো আদায় করতে না পারলে পরেও আদায় করা যায়। কেউ আদায় না করে মারা গেলে তার পক্ষ থেকে তার উত্তরাধিকারী দিয়ে দিলেও আদায় হয়ে যাবে।

ফিতরা আদায় করা মহান আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ একটি আদেশ। বিত্তবান মুসলিম নাগরিকদের ওপর ফিতরা ওয়াজিব করে দেয়া হয়েছে মূলত গরিব-অসহায় মানুষদের হক বা অধিকার হিসেবে। পবিত্র রমজান মাসে রোজা পালনের পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ তায়ালা ঈদের আনন্দ প্রদান করেছেন। গরিব মানুষগুলো এই সমাজেরই মানুষ। তারা সারা বছরই দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে নিদারুণ কষ্টের মাঝে থাকে। তারা কমপক্ষে ঈদের দিন যাতে আনন্দে সবার সাথে শরিক হতে পারে, এ জন্য তাদের কিছু খাদ্য ও বস্ত্রের ব্যবস্থা করে দেয়া উচিত।

ঈদের দিনে যাতে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘোরা থেকে তারা বাঁচতে পারে। সমাজে বসবাসকারী ধনিক শ্রেণীর মানুষদের সাথে গরিবরাও যাতে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে, এ জন্য এই সাদাকাতুল ফিতরের আমলকে ওয়াজিব করা হয়েছে। ফিতরার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে বসবাসকারী ধনীদের অর্থ গরিবদের মধ্যে বণ্টিত হয় এবং এর দ্বারা তাদের জীবন-যাপনে কিছুটা হলেও গতি সৃষ্টি হয়। এ জন্য ইসলামে সাদাকাতুল ফিতরের গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে সমতা আসে এবং সহযোগিতার বিস্তার ঘটে।

নগদ অর্থ দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে কি না এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। রাসূল সা: পণ্য দিয়ে ফিতরা প্রদান করেছেন; অথচ ওই যুগেও মুদ্রা হিসেবে দিরহাম প্রচলিত ছিল। দিরহামের দ্বারা কেনাকাটা, দানখয়রাত করা হতো। মুহাম্মদ সা: খাদ্যবস্তু দিয়ে ফিতরা প্রদান করতেন। এ জন্য মুসলমান পণ্ডিতদের বড় অংশ টাকা দিয়ে ফিতরা প্রদানের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন। ইমাম আহমদ র. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নতের বরখেলাপ হওয়ার কারণে আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, তা যথেষ্ট হবে না।’ ইমাম শাফেঈ, ইমাম মালেক, ইমাম আহমাদ র. এবং সৌদি আরবের খ্যাতনামা আলেমদের মতে- নগদ অর্থ দেয়া বৈধ হবে না। কেননা, হাদিসে নগদ অর্থের উল্লেখ নেই। তবে, ইমাম আবু হানিফা ও তার অনুসারীদের মতে, নগদ অর্থ দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে।

কেননা, আদায়ের অন্যতম লক্ষ্য হলো দরিদ্র মানুষকে ঈদের আনন্দে শরিক করা। দরিদ্র মানুষের যেমন প্রয়োজন খাদ্যের, তেমনি প্রয়োজন কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য সামগ্রীর। সবাই যদি শুধু খাদ্য দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করে, তাহলে হয়তো সংশ্লিষ্ট প্রাপকের ঘরে জমা হয়ে যাবে অঢেল খাদ্য। অথচ তার এত খাবারের প্রয়োজন নেই। বরং প্রয়োজন তার কাপড়-চোপড় কিংবা সেমাই, চিনি ও অন্যান্য সামগ্রী। এ অবস্থায় প্রয়োজন পূরণের জন্য তাকে অতিরিক্ত খাবার বিক্রি করতে হবে। এতে যেমন রয়েছে বিড়ম্বনা, তেমনি বিক্রি করতে হবে তুলনামূলকভাবে কম মূল্যে। এতে হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে দরিদ্র মানুষটি। অতএব ইমাম আবু হানিফার মতে, এ ক্ষেত্রে কোনো সীমাবদ্ধতায় না গিয়ে বিষয়টি উন্মুক্ত রাখাই উত্তম, যাতে সবার জন্যই তা সহজ হয়ে যায়। ইসলাম সহজকে পছন্দ করে যদি তাতে গোনাহ না হয়। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা সহজ করো, কঠিন করো না’ (বুখারি, মুসলিম)।

সাদাকাতুল ফিতর প্রদানের পরিমাণের ক্ষেত্রে ইনসাফ করতে হবে। যেমন- সাদাকাতুল ফিতর গম, যব, খেজুর, কিশমিশ আর পনির দিয়ে আদায় করা যায়। বিভিন্ন পণ্য নির্ধারণের মৌলিক উদ্দেশ্য হলো- যাদের ওপর এই ফিতরা ওয়াজিব, তাদের আর্থিক অবস্থার ভিন্নতার কারণে সুবিধামতো এবং সামর্থ্য অনুযায়ী পণ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করতে পারেন। আসলে উত্তম হলো সর্বোচ্চ মূল্যের পণ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা। ধনীদের সর্বোচ্চ এবং সাধারণদের মাঝামাঝি মূল্যে আদায় করা শ্রেয়। সবচেয়ে ইনসাফ হলো- যারা যে চালের ভাত খান বা যারা যে খেজুর দ্বারা ইফতার করেন, তারা এর সমমানের বা সমমূল্যের ফিতরা আদায় করবেন। রাসূল সা: বলেছেন, ‘তাই উত্তম, দাতার কাছে যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি’ (বুখারি)। একজন মুসলমানের মুখে হাসি ফুটানো উত্তম সদকা। ফলে সাদাকাতুল ফিতরের মাধ্যমে সওয়াবের পাশাপাশি গরিব-অসহায়দের ঈদ আনন্দে শরিক করে মুখে হাসি ফোটানোর সওয়াবও পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশন দেশের সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে। এ ছাড়াও, বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামি সংস্থা, ইমাম, খতিবসহ যারাই এ বিষয়টির সাথে জড়িত, সবার উচিত ফিতরা নির্ধারণ বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা এবং সবার মধ্যে সামর্থ্য অনুযায়ী সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের আগ্রহ সৃষ্টি করা। ফিতরা আদায় করা মূলত প্রত্যেক উপযুক্ত ব্যক্তির নিজস্ব দায়িত্ব। এটা গরিবের হক যা নষ্ট করা কোনোভাবেই উচিত হবে না। তাই আমাদের সবার দায়িত্ব হলো নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী বেশি মূল্যের পণ্য দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করে নিজে লাভবান হওয়া এবং গরিবদের বেশি সহযোগিতা করা।

বাংলাদেশের মুসলমানেরা টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করতে চাইলে দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম মধ্য মানের চালের মূল্য পরিশোধ করতে হবে। জাকাত বোর্ড প্রতি বছর শহর ও গ্রাম এলাকার জন্য ফিতরার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এ বছরও সরকার ফিতরার সর্বনিম্ন ৭০ এবং সর্বোচ্চ এক হাজার ৯৮০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সম্ভব হলে চাল বা খাদ্যবস্তু দিয়ে ফিতরা প্রদান করা ইনসাফপূর্ণ হবে বলে অনেকে মনে করেন।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement