২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

নতুন ছকে ভারত-মিয়ানমার সম্পর্ক

- ছবি : সংগৃহীত

মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে এখন তুমুল সংঘর্ষ চলছে। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান চালাচ্ছে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। স্থলবাহিনীর অভিযানে খুব একটা সুবিধা না করতে পেরে এখন বিমানবাহিনীকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু তবুও তেমন কোনো সাফল্য পাচ্ছে না মিয়ানমার বাহিনী। অন্য দিকে মিয়ানমার বাহিনী অভিযান যত জোরদার করছে, আরাকান আর্মির প্রতি জনসমর্থন তত বাড়ছে। এমনকি মিয়ানমার বাহিনীর অভিযানের মুখেও অনেক বাড়িতে আরাকান আর্মির পতাকা উড়তে দেখা যাচ্ছে।

আরাকান আর্মির এই প্রতিরোধ কিন্তু বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তারা কেবল মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধেই লড়াই করছে না, সেইসাথে ভারতীয় বাহিনীর চাপও মোকাবেলা করছে।

সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, আরাকান আর্মির ওপর ভারতীয় বাহিনীও হামলা চালাচ্ছে। আর তা হচ্ছে পারস্পরিক ভিত্তিতে।

খবরে প্রকাশ, মিয়ানমার সেনাবাহিনী তথা তাতমাদাও ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে দেশটির সাগাইঙ প্রদেশে উত্তর-পূর্ব ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর যেমন হামলা চালিয়েছে, একইভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী ওই মাসেরই শেষ দিকে মিজোরাম রাজ্যের দক্ষিণে আরাকান আর্মির (এএ) ক্যাম্পগুলোতে আক্রমণ করেছে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরামের চিমতুইপুই জেলায় এএ’র তিনটি ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেয়া হয় বলে ভারতীয় সেনাবাহিনী সূত্র জানিয়েছে।

উগ্র জাতীয়বাদী মিডিয়ার কয়েকটি মিডিয়া নির্বাচনী মওসুমের ফ্লেভারের সাথে তাল মিলিয়ে এএ’র ক্যাম্পগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানগুলোকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হিসেবে অভিহিত করেছে। তবে সন্ত্রাস দমনের সাথে সংশ্লিষ্ট আসাম রাইফেলসের শীর্ষ সূত্র জানিয়েছে, অভিযানগুলো ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যেই ছিল।

আরাকান আর্মি কিন্তু অবদমিত হয়নি। এক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ১১ বর্মি সৈন্যকে সশস্ত্র অবস্থায় বন্দী করেছে। উত্তপ্ত রাখাইন রাজ্যের সীমান্তবর্তী চিন রাজ্যের প্যালেতওয়া টাউনশিপে সপ্তাহান্তের সংঘর্ষের পর এদের বন্দী করা হয়। এরপর চলতি মাসের প্রথম দিকে বিদ্রোহী গ্রুপটি প্রাণঘাতী গুপ্ত হামলা চালায়। এতে ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হয়। এ ছাড়া আরেকটি পাইপ বোমা বিস্ফোরণে বর্মি সামরিক বাহিনীর এক অফিসারের স্ত্রী নিহত হয়।

এএ মুখপাত্র খিন থুখা মিডিয়াকে জানান, ৯ মার্চ প্যালেতওয়ার পিয়ন সো গ্রামের পাহাড়ি এলাকায় পালানোর সময় তাদের গ্রুপ বর্মি সৈন্যদের গ্রেফতার করেছে।

বিদ্রোহীরা কেবল প্রাচীন মরাউক-ইউ শহরের ভেতরে ও আশপাশেই তীব্র যুদ্ধ করছে না, সেই সাথে তারা প্যালেতওয়া ব্রিজের জন্য স্টিল গিরডারবাহী একটি বার্জও পুড়িয়ে দেয়। ভারতের তহবিলে কালাদান মাল্টিমডাল প্রকল্পের আওতায় ব্রিজটি নির্মাণ করা হচ্ছিল।
প্যালেতওয়ার কাছে ওই প্রকল্পের আওতায় একটি রাস্তা নির্মাণকাজে জড়িত বর্মি শ্রমিকদেরও অপহরণ করে বিদ্রোহীরা।

ভারতের ওপর বিশেষভাবে ক্রুদ্ধ আরাকান আর্মি। কারণ মিয়ানমার বাহিনীর সাথে সহযোগিতা করছে ভারত। ভারতে অবস্থানরত মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে ভারত। আর বিনিময়ে মিয়ানমারে অবস্থিত ভারতের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে দমন করছে মিয়ানমার।

মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর অভিযানের কারণেই দেশটিতে অবস্থানরত উলফা ও নাগা বিদ্রোহীরা সমস্যায় পড়েছে।
ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তারা এই সহযোগিতায় ব্যাপক সাফল্য পাওয়া গেছে জানিয়ে বলেন, সাগাইঙে বর্মি সামরিক অভিযানের ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। এর ফলে তারা তাদের বৈরী কার্যকলাপ ত্যাগ করে প্রায়ই আত্মসমর্পণ করছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সম্ভবত এবারই প্রথম ভারতীয় ও বর্মি সেনাবাহিনী পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে তাদের নিজ নিজ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত অন্য গ্রুপগুলোর ঘাঁটিতে অভিযান পরিচালনা করেছে।
প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক উপপ্রধান মেজর জেনারেল গগনজিৎ সিঙ বলেন, ভারতীয় বাহিনী যখন কাশ্মিরে কঠিন চাপে রয়েছে, তখন উত্তর-পূর্বের বিদ্রোহী কার্যকলাপ হ্রাসের বিষয়টিকে স্বাগত জানাবে। আবার বর্মিরাও আরাকান আর্মির ক্রমবর্ধমান আক্রমণমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সামরিক চাপকে ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করবে।

বর্মি সেনাবাহিনী ১৯৭০-এর দশকে ভারত থেকে যাওয়া নাগা ও মিজো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল। তারা তাদের ভূখণ্ডে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য চীনের সাহায্য লাভের চেষ্টা করেছিল।

চীন কেবল ভারতীয় বিদ্রোহীদের সমর্থনই করেনি, সেই সাথে বর্তমানে অস্তিত্বহীন বর্মি কমিউনিস্ট পার্টিকেও সহায়তা করেছিল।
তবে ভারত ১৯৮০-এর দশকে বর্মি গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন করলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী উত্তর-পূর্ব ভারতীয় বিদ্রোহীদের টার্গেট করা বন্ধ করে দেয়।

ভারতীয় গোয়েন্দারা মিয়ানমারের কচিন, চিন ও আরাকানি বিদ্রোহীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে ওই সময়কার উত্তর-পূর্ব ভারতীয় বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন বন্ধ করার জন্য।
কিন্তু ১৯৯৮ সাল থেকে দুই সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে আরো ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। এর জের ধরে বর্মি সেনাবাহিনী প্রশিক্ষণ, সামরিক সরঞ্জাম, আরো বেশি সন্ত্রাস দমন সহযোগিতার জন্য ভারতের দ্বারস্থ হয়।

মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সামরিক সম্ভারের প্রধান জোগানদাতা চীন হওয়া সত্ত্বেও ভারতের সাথে মিয়ানমার বাহিনীর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এখন তাই কাজে লাগাচ্ছে তারা। তবে তা কতদূর বিস্তৃত হয় তাই দেখার বিষয়।


আরো সংবাদ



premium cement