২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আরাকান আর্মি : রোহিঙ্গা সঙ্কটে নতুন মাত্রা

-

নতুন বছরের শুরুতেই নতুন করে আলোচনায় এসেছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। এবারে অবশ্য রোহিঙ্গা মুসলিমরা নয়, বৌদ্ধ আরাকান আর্মি (এএ) আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আরাকান জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র গ্রুপ আরাকান আর্মির (এএ) অভিযানে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য হতাহত হওয়ার ফলে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, তার জের ধরে এখনো সেখানে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধেও সামরিক অভিযান শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। আর এতে করে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি ত্যাগের ঢল সৃষ্টি হতে পারে বলেও অনেকে ভয় পাচ্ছেন। ফলে রোহিঙ্গা সঙ্কটে নতুন মাত্রার সৃষ্টি করেছে এই ঘটনা।

হামলা চালানোর কারণ হিসেবে এএ প্রধান মেজর জেনারেল তুন মিয়াত নাইং দ্য ইরাবতিকে বলেন, তারা চান মিয়ানমারে কনফেডারেশন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।

তিনি বলেন, ‘কনফেডারেশনে, আমাদের সিদ্ধান্ত আমাদের নেয়ার এখতিয়ার রয়েছে। কিন্তু একটা সম্মিলিত প্রতিরক্ষা সিস্টেম থাকবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ ও পররাষ্ট্র বিষয়ে সমন্বয় থাকবে। নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারই প্রত্যেক জাতিগত গ্রুপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, এটা রাখাইন রাজ্যের ইতিহাস এবং আরাকান জনগোষ্ঠীর জন্য মানানসই।

মেজর জেনারেল তুন মিয়াত নাইং বলেন, আরাকান আর্মি ফেডারেল পলিটিক্যাল নেগোসিয়েশন অ্যান্ড কনসাল্টেটিভ কমিটির (এফপিএনসিসি) প্রণীত সাধারণ নীতির সাথে একমত। জাতিগত সাতটি সশস্ত্র গ্রুপ নিয়ে এই কমিটি গঠিত, যেটির নেতৃত্ব দিচ্ছে ইউডব্লিউএসএ। আরাকান আর্মি বর্তমানে রাখাইন রাজ্যের ভেতরে-বাইরে আরাকান জনগণের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে।

শান্তি আলোচনায় যোগ দেয়ার জন্য সরকার যে ন্যাশনওয়াইড সিজফায়ার এগ্রিমেন্ট প্রস্তাব করেছে, তার বদলে এই সাধারণ নীতি নিয়ে এসেছে এফপিএনসিসি। এতে ১৫টি দাবি জানানো হয়েছে এবং রাজ্যের ভবিষ্যৎ কাঠামো হিসেবে কনফেডারেশন সিস্টেমের দাবি জানানো হয়েছে।

আরাকান ন্যাশনাল পার্টির ভাইস চেয়ারপারসন দাও আয়ে নু সেইন আরাকান আর্মির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে তিনি উল্লেখ করেন, এএনপি আরাকান জনগোষ্ঠীর দাবি ও আকাক্সক্ষাগুলো প্যাংলং পিস কনফারেন্সে তুলে ধরেছে। তবে সেগুলো ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার সীমা ছাড়িয়ে গেছে বলে, সেগুলোর সমালোচনা করা হয়েছে।

কারা আরাকান, কারা এএ?
বর্তমানের রাখাইন রাজ্যটির একসময়ের নাম ছিল আরাকান। বর্তমানে এখানকার প্রধান জনগোষ্ঠী হলো আরাকানি। ধর্মে তারা থেরোবাদী বৌদ্ধ। তবে মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের বৌদ্ধদের থেকে তারা নিজেদের আলাদা বলে দাবি করে থাকে।
এর উত্তরে চিন স্টেট, ম্যাগওয়ে রিজিয়ন, বাগো রিজিয়ন, পূর্বে ইরাবতি অঞ্চল, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর ও উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অবস্থিত। আরাকান পর্বতমালা দিয়ে এটি মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা।

আরাকানিদের ইতিহাস বেশ প্রাচীন বলে তারা দাবি করে থাকে। স্বাধীন আরাকান রাজ্যের অস্তিত্ব দীর্ঘ সময় ধরে ছিল। সুলতানি আমলে বাংলার সুলতানদের সাথে এই রাজ্যের শাসকদের নানামাত্রিক সম্পর্ক ছিল। ১৭৮৪-৮৫ সালে যুদ্ধে মিয়ানমার বা বার্মার অধীনস্থ হয় আরাকান। তারপর ব্রিটিশদের হাতে যায় প্রায় পুরো মিয়ানমার। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার (বার্মা) একটি প্রদেশ হয় আরাকান। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভের পর নতুন ফেডারেল প্রজাতন্ত্রে রাখাইন বা আরাকান হয় এর একটি অংশবিশেষ।

আর আরাকান আর্মি গঠিত হয় ২০০৯ সালে। তারা হলো ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের (ইউএলএ) সশস্ত্র শাখা। বর্তমানে এর প্রধান মেজর জেনারেল তুন মিয়াত নাইং। তাদের লক্ষ্য আরাকানি জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্রতা রক্ষা করা।
এই সশস্ত্র গ্রুপটি কচিন সঙ্ঘাতেও জড়িত রয়েছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির (কেআইএ) সাথে লড়াই করছে। এএ’র বেশির ভাগ সৈন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছে কেআইএ মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে। অবশ্য রাখাইন রাজ্যেও তাদের আলাদা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। বর্তমানে তাদের সৈন্য সংখ্যা সাত হাজারের মতো বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।

মিয়ানমার-আরাকান-রোহিঙ্গা
মিয়ানমার বাহিনীর বিরুদ্ধে আরাকানিরা লড়াই করলেও দুই পক্ষের মধ্যে একটি বিষয়ে মিল রয়েছে। তা হলো- দুই পক্ষের কেউই রোহিঙ্গাদের তাদের বলে মনে করে না। মূলত আরাকানি বৌদ্ধরাই রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ। ২০১২ সালের দাঙ্গা সৃষ্টি করেছিল তারাই। রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারের নাগরিক অধিকার না পেতে পারে, সে জন্য তারা জোরালো আন্দোলন করে যাচ্ছে। তাদের দাবি, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী। তাদের হাতেই রোহিঙ্গা মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে।

মিয়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যে সশস্ত্র আন্দোলন চলছে। সামরিক বাহিনী তাদের দমন করতে হিমশিম খাচ্ছে। বিদ্রোহীদের আক্রমণ এতদিন থাইল্যান্ড ও চীন সীমান্তে কেন্দ্রীভূত থাকলেও এখন রাখাইনেও তা ছড়িয়ে পড়ার ফলে ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

কেবল জাতিগত কারণেই নয়, এ অঞ্চলের ভূকৌশলগত কারণেও রাখাইন রাজ্যটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন এখানে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। একটি গভীর সমুদ্রবন্দর, অর্থনৈতিক অঞ্চল, জ্বালানি সরবরাহ লাইন নির্মাণ করে যাচ্ছে। অনেকের মতে, চীন যাতে এসব প্রকল্প সাবলীলভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারে, সে জন্য পাশ্চাত্যের নানা স্থান থেকে অস্থিতিশীলতায় ইন্ধন দেয়া হচ্ছে। তবে মিয়ানমার সরকার যে উগ্র পন্থা গ্রহণ করে আসছে, তাতে করে ক্ষোভ সৃষ্টি স্বাভাবিক ব্যাপার। এ সব ক্ষোভ, অন্যায়-অবিচার দূর না করলে এমনিতেই অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে বাধ্য।


আরো সংবাদ



premium cement