২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আত্মঘাতী নীতিতে কেন মেতে উঠল এনসিটিবি?

আত্মঘাতী নীতিতে কেন মেতে উঠল এনসিটিবি? - ছবি : সংগ্রহ

আমাদের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে আখ্যায়িত করে আমাদের পুরো জাতিসত্তা ও শিশুরাষ্ট্রটিকে চরমভাবে অপমানিত করেছিলেন। আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের মনেই তখন নিজপায়ে দাঁড়ানোর একটি প্রবল জেদ ও আকাক্সক্ষার সুপ্ত বীজ ছিল। স্বয়ংসম্পন্নতার অর্থনীতির বুনিয়াদ সৃষ্টি করতেই আমাদের সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ১৯৯১ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব হাতে পেয়ে ভ্যাট-ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। প্রথম দিকে এর তীব্র বিরোধিতা হলেও পরবর্তীকালে মানুষ এর প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় এবং একে অকপটে মেনে নেয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হলেও এর ধারাবাহিকতা আরো সম্প্রসারিত হয়।

২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে হয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে যোগাযোগব্যবস্থা নির্বিঘ্ন করতে পদ্মা সেতু নির্মাণের মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে। এতে বাদ সাধে আমাদের একসময়কার দাতা সংস্থাগুলো, যারা পরে ‘উন্নয়ন সহযোগী’ হিসেবে আমাদের অবকাঠামোগত খাতে যুক্ত হয়। উন্নয়ন সহযোগী তথা বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফের শত বাধার বিন্ধ্যাচল কাটিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর সুবিশাল অবকাঠামো আজ স্বমহিমায় এগিয়ে চলছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-কে পাশ কাটিয়ে নিজস্ব অর্থনীতি গড়ার ইতিবাচক প্রবণতা আজ রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরেই পরিলক্ষিত হচ্ছে।

দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, সরকারের এ মহতী উদ্যোগ এবং সুকুমার বৃত্তিকে কিছু অসাধু সরকারি কর্মকর্তা নিজস্ব ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে সরকার আমানত হিসেবে যে ক্ষমতা তাদের অর্পণ করেছে, তার চরম অপব্যবহার করে চলেছেন। রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার তাদের নেই। এতে সরকারের গৃহীত মহতী উদ্যোগকে যেমন এক দিকে চূড়ান্ত অর্থে নস্যাৎ করে চলেছেন; অন্য দিকে পুরো কর্মপ্রবাহে বিঘœ সৃষ্টি করে পুুরো গণসেবা খাতকেই ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করানোর মতো আত্মঘাতী কাজ করে যাচ্ছেন। একজন মানুষের খেয়ালখুশির জন্য একটি সুবিশাল খাত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

সরকারের সফলতা-ব্যর্থতার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সফলতা হলো, বছরের প্রথম দিনই আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া। নিঃসন্দেহে এটি সর্বমহলেই ব্যাপকভাবে নন্দিত উদ্যোগ। অন্য দিকে পুস্তক ব্যবসায়ীদের বরাবরে আমাদের জন্য আরেকটি ইতিবাচক ও গর্ব করার মতো সংবাদ হচ্ছে, বই ছাপার কাজে চলতি বছর বিশ্বব্যাংক কিংবা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ধরনের সহায়তা নেয়নি সরকার। ব্যাপারটিকে আরো বিস্তারিত পরিসরে বলতে হয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আগামী শিক্ষাবর্ষের (২০১৯ সালের জন্য) বিনামূল্যে পাঠ্যবই ছাপার জন্য দাতাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের সহায়তা না নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় বই মুদ্রণের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানে কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। বিশ্বব্যাংক বা কোনো দাতা সংস্থার চাপও ছিল না।

উল্লিখিত প্রসঙ্গটি যে কারণে খুবই উল্লেখযোগ্য ও বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে তা হলো, জাতীয় শিক্ষা ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কৃষ্ণা প্রিন্টার্স ও স্বপ্না ট্রেডিং নামে দুটো কালো তালিকাভুক্ত ভারতীয় মুুদ্রণপ্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে নির্লজ্জ চালাকি ও ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, নিজস্ব অর্থায়নে পুস্তক ছাপানো হলে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানে কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতা থাকে না। অথচ এনসিটিবি চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্রসাহা সব ধরনের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে একক সিদ্ধান্তে উল্লিখিত দু’টি কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে পুনঃদরপত্র আহ্বান করেছেন বলে অভিযোগ করেছে দেশীয় মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মুদ্রণ মালিক সমিতি। অভিযোগে তারা বলেন, পুনঃদরপত্র না করে প্রাথমিকের কার্যাদেশ দেয়া যেত, যদি দরপত্র পুনঃদরপত্র পুনর্মূল্যায়ন করা হতো। এতে সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হতো এবং বইও যথাসময়ে পাওয়া যেত। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে এমন দুই ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, এ কাজে যাদের কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই।

এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান যে জটিলতার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে তা হলো পুনঃদরপত্রের কার্যাদেশ দেয়ার পর মুদ্রণকারীদের সাথে চুক্তি করতে আরো ২৮ দিন সময় দিতে হবে। ফলে অক্টোবরের মধ্যে বই ছাপিয়ে উপজেলাপর্যায়ে পৌঁছানোর সরকারি সিদ্ধান্ত প্রায় অসম্ভব। এখন থেকে ২৮ দিন পর চুক্তি হলে বই সরবরাহ করতে তারা সময় পাবে আরো ৬০ দিনের মতো। এ ক্ষেত্রে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বই ভারত থেকে ছাপিয়ে দেশের উপজেলাপর্যায়ে পৌঁছে দেয়া অসম্ভব। এ অবস্থায় ১ জানুয়ারি ২০১৯ প্রাথমিকের কোনো শিক্ষার্থী পাঠ্যবই হাতে পাচ্ছে না, এটা প্রায় নিশ্চিত। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ মতে, বই ছাপার জন্য এনসিটিবি যখন প্রথম দরপত্র আহ্বান করেছিল, তখন কোনো কোনো বিদেশী প্রতিষ্ঠান যোগ্যতা ও টেন্ডারের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়ে বাদ পড়েছিল। বাদ পড়াদের মধ্যে এখন কাজ পাওয়া দু’টি প্রতিষ্ঠানও ছিল। শুধু এ দু’টির কালো তালিকাভুক্ত অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতেই পুনঃদরপত্র আহ্বানের নাটক সাজিয়েছে এনসিটিবি। ইতোমধ্যে পুনঃদরপত্রে কাজ পাওয়া মুদ্রাকরদের নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়েছে। এতে এ দু’টি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কৃষ্ণা প্রিন্টার্স ও স্বপ্না ট্রেডিং ১০টি লটে এক কোটি চার লাখ ৫৩ হাজারের বেশি বই ছাপার কাজ পেয়েছে। আর এতে শুধু প্রাথমিকের বই ছাপায় সরকারের অতিরিক্ত গচ্চা যাচ্ছে ১১১ কেটি টাকা। কৃষ্ণা প্রিন্টার্স এক লটে ৭১ লাখ ৫৭ হাজার ৪১৩ এবং স্বপ্না ট্রেডিং এক লটে ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ১৭২টি বই ছাপার কাজ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠান দু’টি ২০১৬ সালে বই ছাপার কাজ সম্পন্ন করতে প্রায় তিন মাস দেরি করে ডিসেম্বরের বই মার্চ পর্যন্ত নিয়েছিল। এ জন্য এনসিটিবি এদের কালো তালিকাভুক্ত করেছিল।

মন্ত্রাণালয় ও এনসিটিবির বরাতে দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ, ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক বইয়ের প্রতি ফর্মা দুই টাকা ২৫ পয়সা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে প্রথম দরপত্র আহ্বান করে এনসিটিবি। গত ডিসেম্বরের প্রাক্কলনের সাথে জুন মাসের কাগজ-কালিসহ আনুমানিক অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা দুই টাকা ৬৩ পয়সা থেকে দুই টাকা ৯৩ পয়সা পর্যন্ত ফর্মার দাম ধরে দরপত্র জমা দেন। এতে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ দাম বেড়ে যাওয়ায় পুরো টেন্ডার নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এনসিটিবি প্রাক্কলিত দরের চেয়ে বেশি হওয়ায় পুনঃদরপত্র করার পক্ষে মত দেয় দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। এ নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এনসিটিবির মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক হয়। অক্টোবরের মধ্যে বই দিতে হলে দরপত্র বহাল রেখে ওয়ার্ক অর্ডার দিতে মত দেন এনসিটিবির এক সদস্য। একপর্যায়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে কমিটি থেকে বেরিয়ে যান তিনি। এরপর পুনঃদরপত্র আহ্বান করে আগের দামেই নোটিফিকেশন অব অর্ডার (এনও) দেয় এনসিটিবি। অর্থাৎ মুদ্রণকারীরা প্রথম দরপত্রে যে দর দিয়েছিল, প্রায় ওই দরেই পুনঃদরপত্রে কাজ দেয়া হয়েছে।

তারপরও পুনঃদরপত্র আহ্বান করে দু’টি অযোগ্য ও ব্যর্থ বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে কাজ অর্পণ করায় আমাদের মুদ্রণ মালিক সমিতি ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ ও আহত হয়েছে। এটি দেশীয় শিল্পকে ধ্বংসের মহাষড়যন্ত্র বলে তারা উল্লেখ করেন।
এ ব্যাপারে আমাদের ইতোমধ্যে যুদ্ধপূর্ব অভিজ্ঞতাগুলোও বড়ই করুণ ও তিক্ত। দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে বই না ছাপিয়ে ভারত থেকে বই ছাপানোর কারণে নির্ধারিত সময়ে যেমন বই পাওয়া যায় না, তেমনি নি¤œমানের কাগজে ও খারাপ ছাপা বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয়। বই ছাপায় প্রথমে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। যদি দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অপারগ হয়, তাহলেই কেবল বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু গচ্চা দিয়ে বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে কেন কাজ দেয়া হচ্ছে? কার স্বার্থে দেয়া হচ্ছে? জাতি এসব প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জবাব জানতে চায়।


আরো সংবাদ



premium cement