বাংলাদেশে পীর-সুফি রাজনৈতিক দলগুলোর ভবিষ্যৎ কী?
- বিবিসি
- ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:৪৫
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পীর বা সুফি নেতাদের নেতৃত্বাধীন দলগুলো দশকের পর দশক ধরে কাজ করলেও বিকল্প এবং স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে ঘিরে দুই জোটের রাজনীতিতেই ঘুরপাক খাচ্ছে এসব দলের রাজনীতি। পীর বা সুফি নেতাদের নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থী দলগুলোর উদ্দেশ্য আসলে কী? বাংলাদেশে এই দলগুলোর ভবিষ্যৎ কেমন- এসব প্রশ্ন এখন অনেকে তুলছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। সেই সুযোগ নিয়ে তখন নিষিদ্ধ ইসলামপন্থী কয়েকটি দল আবার রাজনীতি শুরু করেছিল। আশির দশকের শেষদিকে তাতে যুক্ত হয়েছিল পীরদের রাজনীতি। কয়েকজন পীর বা সুফি নেতা ইসলামপন্থী দল গঠন করে রাজনীতির মাঠে নেমেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরিন বলেন, জেনারেল এরশাদ তার ক্ষমতার স্বার্থে ধর্মকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিলেন এবং তার পৃষ্ঠপোষকতাতেই তখন দল গঠন করে পীরদের রাজনীতিতে নামতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশে সুফিবাদের চর্চা দীর্ঘ দিনের। কিন্তু ৮০ সালের পর থেকে বিশেষ করে সামরিক শাসক এরশাদের সময় ১৯৮৭ সালে প্রথম তার পৃষ্ঠপোষকতায় চরমোনাই পীরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। এরপর আমরা দেখেছি ১৯৮৮ সালে ইসলাম রাষ্ট্র ধর্মের স্বীকৃতি পায়। জোবাইদা নাসরিন আরও বলেন, শর্ষিণার পীরকে জেনারেল এরশাদ স্বাধীনতা পদক দিয়েছিলেন। সেই আমল থেকেই পীর এবং ইসলামকে আমাদের দেশের রাজনীতিতে ব্যবহার করার ব্যাপারটি ভিন্নমাত্রা পায়।
দেশে ইসলামপন্থী দলের সঠিক সংখ্যা বলা মুশকিল। পীর বা তাদের বংশধরদের নেতৃত্বে দলের সংখ্যাও কম নয়। তবে পীরদের দলগুলোর মধ্যে মাত্র চারটি দল নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পেয়ে কাজ করছে। এই দলগুলো ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠাকেই মূল লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু সেই লক্ষ্যের ক্ষেত্রেও মতবাদ এবং চলার পথ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য বেশ প্রকট। এমন প্রেক্ষাপটে তারা আসলে কী করতে চায়- এই প্রশ্ন তোলেন বিশ্লেষকরা। বরিশালের চরমোনাইর পীর হিসেবে পরিচিত সৈয়দ ফজলুল করিম ইসলামী আন্দোলন নামে দল গঠন করে রাজনীতিতে নেমেছিলেন জেনারেল এরশাদের আমলে ১৯৮৭ সালে। নিবন্ধিত এই দলের প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পর তার ছেলে সৈয়দ রেজাউল করিম এখন পীর এবং দলের নেতা হিসেবে কাজ করছেন।
প্রতিষ্ঠা থেকেই তিন দশকেরও বেশি সময়ে দলটিকে ক্ষমতাসীন বা বড় কোনো দলের সাথেই থাকতে দেখা গেছে। তবে এই দলের মহাসচিব ইউনুস আহমাদ বলেছেন, তারা নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান। আরেকটি ইসলামপন্থী দল জাকের পার্টিও প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পার করেছে। জেনারেল এরশাদের শাসনের সময়ই ১৯৮৯ সালে দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফরিদপুরের আটরশির পীর হিসেবে পরিচিত শাহ সুফি মো: হাশমতউল্লাহ। তখনই তিনি ছেলে মোস্তফা আমীর ফয়সালকে চেয়ারম্যান করেছিলেন। জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে জাকের পার্টি গোলাপ ফুল প্রতীক নিয়ে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯টিতে প্রার্থী দিয়েছিল। বর্তমানে জাকের পার্টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে রয়েছে। দলটিতে এখন তৃতীয় প্রজন্মকে নেতৃত্বে আনা হচ্ছে। এর প্রতিষ্ঠাতার নাতি ড: সায়েম আমীর ফয়সালকে জাকের পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়েছে।
পীরদের দলগুলোর মধ্যে শুধু তরিকত ফেডারেশনের নেতা সৈয়দ নজিবুল বাশার মাইজভাণ্ডারী বর্তমান সংসদে যেতে পেরেছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক হিসেবে তিনি নৌকা প্রতীকে চট্টগ্রামের একটি আসন থেকে নির্বাচনে জিতেছিলেন। তরিকত ফেডারেশন এবং জাকের পার্টি ইসলামপন্থী দল হলেও তারা ধর্মনিরপেক্ষ এবং উদারনীতির ভিন্ন রাজনীতির কথা বলছে। আর চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন প্রচলিত ব্যবস্থা পাল্টিয়ে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের অবস্থানকেই তুলে ধরছে। তবে এই দলগুলোকে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির ওপর ভর করেই এখন রাজনীতির মাঠে থাকতে দেখা যায়। জোবাইদা নাসরিন বলেন, বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতি এবং দেশ শাসনের ব্যাপারে ধর্মভিত্তিক দলকে সমর্থন করে না। সে কারণে এসব দল বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না বলে তিনি মনে করেন। পীরবাদী দলগুলোর এককভাবে রাজনৈতিক সমর্থন আছে, এটা আমি মনে করি না। আসলে বাংলাদেশে মিশ্র সংস্কৃতির ইতিহাস। বাংলাদেশের মানুষ মানবিক দিক থেকে অনেক বেশি সেকুলার। এখানে বহুত্ববাদের সংস্কৃতি আছে। ফলে মানুষ তাদের গ্রহণ করবে না বলে আমার মনে হয়।
এই দলগুলোর নেতাদেরও অনেকে তাদের বিকল্প বা স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়ে দাঁড়াতে না পারার বিষয়টি স্বীকার করেন। কিন্তু একই সাথে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ছে। এই পরিস্থিতি তাদেরকে নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে বলে তারা মনে করেন। এ ছাড়া পীর হিসেবে পাওয়া মানুষের সমর্থন রাজনীতিতে কাজে লাগানোর চিন্তা থেকে এই দলগুলো গঠন করেছিলেন নেতারা। কিন্তু রাজনীতিতে তা কাজ করেনি।
তরিকত ফেডারেশনের নেতা সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, তারা এখনো সমমনাদের সাথে থেকে ঐক্যের ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
যদিও ইসলামপন্থী এই দলগুলো মনে করছে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি মানুষ এখন ঝুঁকছে তারা ভোটের বা ক্ষমতার রাজনীতিতেও একটা প্রভাব রাখতে পারছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াতে ইসলামী ছাড়া ইসলামপন্থী অন্য দলগুলোর ভোটের হিসাব এখনো নগণ্য পর্যায়ে রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ধর্মের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে মানুষ এখনো সেভাবে সমর্থন করছে না বলে তিনি মনে করেন। পীর বা তাদের বংশধরদের রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশে কাছাকাছি সময়ের মধ্যে একটা শক্তি হিসেবে দাঁড়াবে- এমন বিশ্বাস এখনো দলগুলোর নেতৃত্বের মাঝেও তৈরি হয়নি। তবে দলগুলোর নেতারা মনে করছেন, বড় দলগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টিকারী শক্তি হিসেবে একটা অবস্থান তারা করতে পেরেছেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা