২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রেলওয়ে বিভাগে ৫০০ কোটি টাকা লুটপাট

লিমিটেড টেন্ডারিং
-

লিমিটেড টেন্ডারিং ম্যাথডের (এলটিএম) নামে রেলওয়ে বিভাগে চলছে লুটপাট। অভিযোগ রয়েছে, এই পদ্ধতি অবলম্বন করে রেলওয়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা বছরে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। বছরের পর বছর ধরে লিমিটেড টেন্ডারিং ম্যাথডের নামে এই লুটপাট চললেও জড়িতরা রয়েছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অথচ এলটিএম ও পঞ্চাশ ভাগ দুর্নীতি বন্ধ হলে বছরে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা।
অবশ্য রেলওয়ে বিভাগের মহাপরিচালক শামছুজ্জামান এ ব্যাপারে বলেন, গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে এলটিএম বন্ধ রয়েছে। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর এই পদ্ধতি বন্ধ করেছি। তবে আগে এই পদ্ধতিতে কোনো দুর্নীতি হয়েছে কি না সেটা আমার জানা নেই।
রেলওয়ের এই দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে এবং এর প্রতিকার চেয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে। শোভন আলী নামে জনৈক ব্যক্তির স্বাক্ষরিত এই অভিযোগে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা এলটিএমের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। এর মধ্যে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি না দিয়েই রেলওয়ের রাজশাহী জোনে এলটিএম (লিমিটেড টেন্ডারিং ম্যাথড) পদ্ধতিতে ৩৫০ কোটি টাকার কাজ ভাগবাটোয়ারা করেন। শুধু তাই নয়, স্টেশন এলাকা ও রেলের স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ধরে রাখতে রাজশাহী জোনেই ব্লিচিং পাউডার ক্রয়ের নামে এক বছরে নয় কোটি টাকা লোপাট করেছে।
অথচ সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অধিকাংশ ট্রেনের লোকোমেটিভ চলাচলের সময় অচল হয়ে পড়ছে। কিন্তু দেশের ক্রয় বিধিমালা অনুযায়ী দুই লাখ টাকার বেশি মালামাল ক্রয় বা কাজ করাতে হলে পত্রিকায় বিজ্ঞিপ্তি দিতে হয় ঠিকাদার নিয়োগের জন্য। তবে আপতকালীন জরুরি প্রয়োজনে শুধু রেলওয়ের লোকমেটিভের (ইঞ্জিন) যন্ত্রাংশ টেন্ডার ছাড়াই ক্রয়ের বিধান রয়েছে। কিন্তু রেলওয়ের রাজশাহী জোনে রমজান আলী প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকাকালে স্টেশন মেরামতসহ আনুষঙ্গিক ৩৫০ কোটি টাকার কাজ হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানির মধ্যে বণ্টন করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, অতিরিক্ত মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় বর্তমান মহাপরিচালক তার বন্ধু আফসার আলীর বিশ্বাস বিল্ডার্সকে দিয়েছেন ১১ কোটি টাকার কাজ। টেন্ডার (দরপত্র আহ্বান) ছাড়াই নিজস্ব কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এলটিএম (তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বচ্চে ও সর্বনিম্ন দেখানো) দেখিয়ে অধিকাংশ কাজ হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করেছেন। এমনকি ঠিকাদার আফসার আলী বিশ^াসের সাথে যশোরে বেনামে ‘স্প্রিজা মেটাল’ নামে একটি কারখানা গড়ে তুলেছেন। বিদেশী উন্নতমানের যন্ত্রাংশের পরিবর্তে ‘স্প্রিজা মেটাল’ কারখানা থেকে রেলওয়েতে নিম্নমানের স্প্রিংসহ যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে। গত ১০ সেপ্টেম্বর এলটিএম প্রক্রিয়ায় তিন কোটি ৫০ লাখ টাকার মালামাল ক্রয় করা হয়। কিন্তু সরবরাহ করা সে মালামাল নিম্নমানের মানের হওয়ায় সহকারী প্রকৌশলী তা গ্রহণে অসম্মতি জানান।
অভিযোগে বলা হয়, রাজশাহী জোনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রমজান আলী বর্তমানে খুলনা-মংলা রেলপথ প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে টেন্ডার আহবান করা হলে এর মাধ্যমে শুধু দরপত্রই বিক্রি হতো ৭০ লাখ টাকার। আর দরপত্র আহ্বান করে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দিলে সরকারের প্রায় শত কোটি টাকা বেঁচে যেত। প্রাক্তন প্রধান প্রকৌশলী রমজান আলী বাংলাদেশ রেলওয়ে রাজশাহীতে দুই বছর তিন মাস কর্মরত অবস্থায় আইনবহির্ভূতভাবে প্রায় ৩৫০ টাকার এলটিএম করিয়েছেন। অসৎ উদ্দেশ্যে প্রতিটি কাজের প্রাক্কলন তৈরি করেছেন প্রয়োজনের চেয়ে ২০ ভাগ বেশি করে। যার ফলে রেলওয়ের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা।
অভিযোগে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজস্ব বাজেটের ৭০ ভাগ যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগ খরচ করে থাকে। কোচ রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও সৈয়দপুর প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার এলটিএমের মাধ্যমে বিভিন্ন মালামাল ক্রয় করে তাদের ইচ্ছামতো বাজার দর ধরে। এ কারণে অনেক সময় ১০০ টাকার মাল ১০ হাজার টাকায় ক্রয় করা হয়। অনেক সময় মালামাল না ক্রয় করে সাপ্লাইয়ারের সাথে টাকা ভাগাভাগি করে নেয়।
অভিযোগে বলা হয়, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম জোনে মেকানিক্যাল বিভাগে প্রতি বছর কমপক্ষে ১২০ কোটি টাকার মালামাল ক্রয় করা হয়। এর মধ্যে সবই ক্রয় করা হয় দরপত্র আহ্বান না করে এলটিএম প্রক্রিয়ায়। এর ফলে ১০০ টাকার কোনো জিনিস ক্রয়ের সময় দেখানো হয় ১০ হাজার টাকা। এ ছাড়া রেলওয়েতে তেলবাহী ট্যাংকার ও ওয়াগনের যে দুর্ঘটনা ঘটে তার ৭০ শতাংশ ঘটে নতুন স্প্রিং না লাগিয়ে পুরনো স্প্রিং লাগানোর ফলে। অভিযোগে বলা হয়, রেলওয়ের তেলবাহী ট্যাংকার ও ওয়াগনে স্প্রিং না লাগিয়ে বছরে কোটি কোটি টাকা লুট করে মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্ট। দেখা যায় রেলের যত দুর্ঘটনা ঘটে তার ৭০ ভাগ মেকানিক্যাল ত্রুটির কারণে।


আরো সংবাদ



premium cement