০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১,
`
ফিরে দেখা ২০১৯

২৩ হাজার অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন ১৮৬ জন

২৩ হাজার অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন ১৮৬ জন - ফাইল ছবি

বনানীর এফআর টাওয়ার, পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা, কেরানীগঞ্জ ও গাজীপুরের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বছরজুড়ে কাঁদিয়েছে বাংলাদেশকে। দেশের ইতিহাসে আলোচিত কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে চলতি বছরে। সারা দেশে বছরজুড়ে এ রকম ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ২৩ হাজার। প্রাণ হারিয়েছেন ১৮৬ জন। জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও অনেকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়েছেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে চলতি বছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ও প্রাণহানি দুটোই ছিল গত বছরের চেয়ে অনেক বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে সারা দেশে মোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২২ হাজার ২৮৩টি। এতে প্রাণ গেছে ১৮৬ জনের। ২০১৮ সালে মোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল ১৯ হাজার ৬৪২টি। প্রাণ যায় ১৩০ জনের। অর্থাৎ ২০১৮ সালের চেয়ে চলতি বছর ২৬৪১টি আগুনের ঘটনা এবং ৫৬ জনের মৃত্যু বেশি ছিল। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, মোট অগ্নিকাণ্ডের ৩৯ শতাংশের কারণ ছিল বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা ত্রুটি। দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পায়নি বস্তি থেকে শুরু করে কেমিক্যাল গোডাউন বা আধুনিক বহুতল ভবনও। নিহতের পাশাপাশি আহত হয়েছে ৯০০-এর বেশি লোকজন। গত বছর যেটি ছিল ৬৬৪ জন। এবার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। গত বছর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩৮৬ কোটি টাকা। বিগত পাঁচ বছরে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।

কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীর ভয়াবহতা পুরো দেশবাসীকে স্তম্ভিত করলেও সতর্ক করেনি। চলতি বছর ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রমাণ হয় সে কথাই। পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল থেকে আগুন লাগে ওয়াহেদ ম্যানশনে। ১২ ঘণ্টার সে আগুন কেড়ে নেয় ৭৬টি তাজা প্রাণ। কয়েকটি মামলা হলেও ১০ মাসে কোনো অভিযোগপত্র জমা হয়নি। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ফায়ার সার্ভিস এ আগুন থেকে শিক্ষা নিয়ে তৎপরতা দেখালেও স্থানীয়দের বাধার মুখে পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা সরানো সম্ভব হচ্ছে না।

এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অগ্নি অনুবিভাগ) প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, চুড়িহাট্টা ঘটনার পরপরই স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার, শিল্প, গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি উচ্চপর্যায়ে কমিটি করা হয়েছে। কমিটি একাধিক বৈঠক করে ঢাকার ভবনগুলোতে ফায়ার সেফটি নিশ্চিত করাসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ তৈরি করেছে। এ ছাড়াও ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের গঠিত কমিটি একটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে। সেই রিপোর্টের আলোকে রাজধানীতে আবাসিক ভবনের উচ্চতা ১০ তলার বেশি যেন না হয়, সেজন্য গৃহায়ন মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের এ ঘটনা নিয়ন্ত্রণে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।
চকবাজারের চুড়িহাট্টায় বিভীষিকাময় স্মৃতির ক্ষত শুকাতে না শুকাইতে ৫ সপ্তাহের মাথায় অভিজাত বনানী এলাকায় এফআর টাওয়ারে ফের ঘটে আরেক ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা। ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা নির্মাণ করা এই ভবনে প্রাণ যায় ২৬ জনের। পরে মারা যান আহত এক ফায়ার সার্ভিস কর্মীও। এ দু’টি আগুনের ঘটনা বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে। এর দুই দিন পর অগ্নিঝুঁঁকি কমাতে যখন ভবন পরিদর্শনের উদ্যোগ নিচ্ছে সিটি করপোরেশন ও শিল্প মন্ত্রণালয় ঠিক তখনই আগুন লাগে গুলশান কাঁচাবাজারে। এরপর বড় কিছু না হলেও গত ১১ ডিসেম্বর আসে আরেক ট্র্যাজেডি। কেরানীগঞ্জে প্রাইম পেট প্লাস্টিক কারখানার আগুনে দগ্ধ হয়ে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২২ শ্রমিকের। এর ৪ দিন পর গাজীপুরের ফ্যান কারখানায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান ১০ শ্রমিক। সে রাতেই আগুন লাগে হাতিরঝিলের মহানগর প্রজেক্টের বস্তিতে।

গত ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় রূপনগরের চলন্তিকা বস্তিতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। আট থেকে দশ হাজার পরিবার সেখানে বসবাস করত। এ ঘটনায় কেউ নিহত না হলেও অনেকেই আহত হন। অভিযোগ ওঠে ক্ষমতাসীন দলের একটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা এ জায়গাটি দখল করতে আগুন লাগায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও সেই কমিটিতে কারা রয়েছেন এবং তদন্তের অগ্রগতি কতটুকু, সেটি আজ অবধি জানা যায়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি সেবা সংস্থার নজরদারির অভাবে আগুন আতঙ্কের জনপদ হয়ে উঠছে দেশ। চলতি বছর ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় আরো বেশকিছু ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে, যার ভয়ঙ্কর স্মৃতি মানুষ এখনো বহন করছেন। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, চুড়িহাট্টার ঘটনার ছয় দিন আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকার শেরেবাংলা নগর এলাকায় অবস্থিত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এক শিশু রোগী মারা যায়। ওই আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিটকে কাজ করতে হয়। আগুনের কারণ এখনো অজানা। তবে যে রুম থেকে আগুন লেগেছে বলে ধারণা করা হয়, সেখানে ওষুধসহ দাহ্য পদার্থ ছিল। ঘটনার সময় বিদ্যুৎ ছিল না।

ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে যত আগুনের ঘটনা ঘটেছে, এর প্রায় ৩৯ শতাংশের জন্য দায়ী বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট। এরপরই রয়েছে চুলা। চুলা থেকে আগুন লেগেছে ২২.৭ শতাংশ।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে সারা দেশে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৮টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪৯৩ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ২০০৯ সালে ১২ হাজার ১৮২টি। আর সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ২০০৯ সালে ২২ হাজার ২৮৩টি। তবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ২০১১ সালে। ওই বছর ১৫ হাজার ৮১৫টি ঘটনায় ৩৬৫ জন মারা গেছেন। ১০ বছরের হিসাব মতে, এ বছরই সবচেয়ে বেশি আহত হন। এ বছর আহতের সংখ্যা ১ হাজার ৪৭৯ জন। দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যায় দ্বিতীয় স্থানে ২০১০ সাল। ওই বছর ২৭১ জন মারা গেছেন। এই এক দশকে আগুনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ২৮৬ কোটি ৮৬ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৪ টাকা। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, আগুনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে ঢাকায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সারা দেশে ২২ হাজার ২৮৩টি আগুনের ঘটনার মধ্যে ৯ হাজার ১২১টি ঘটনাই আবাসিক ভবনে।


আরো সংবাদ



premium cement