গুম হওয়া সদস্যদের পরিবারের চাপাকান্নায় আবেগঘন পরিবেশ
- অনলাইন প্রতিবেদক
- ২৭ এপ্রিল ২০১৯, ২০:৪৩
স্বামী, সন্তান, কারো বা আপন ভাই গুম হয়েছেন। গত পাঁচ, ছয় কিংবা আট বছর ধরে এ ঘাট থেকে সে ঘাটে স্বজনদের খোঁজে পেতে যারপরনাই ঘুরছেন তারা। স্বজন হারানোর বেদনা আর সংসারের করুণ পরিণতির গল্প বলার সময় গুম হওয়া সদস্যের পরিবারের চাঁপা কান্নায় এক আবেদঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল জাতীয় প্রেসক্লব মিলনায়তনে।
শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত ‘গুম ও গণতন্ত্রের অব্যাহত সংকট’ শীর্ষক আলোচনায় গুম হওয়া সদস্যের পরিবারের এমন বক্তব্যে পিনপতন নিরবতা ছিল পুরো মিলনায়তনে। আগত অতিথিরা বক্তব্যে বলেছেন, গুমের বিচার অবশ্যই একদিন হবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। তারা আরো বলেছেন, গুমের ঘটনায় থানা পুলিশ কিংবা র্যাব যদি অভিযোগ গ্রহণ না করেন তাহলে বুঝতে হবে তারাই এর সাথে জড়িত। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন এলাকার গুম হওয়া ব্যক্তিদের কয়েকটি পরিবারের সদস্য অংশ নিয়ে বক্তব্যে নিজেদের অসহায়ত্বের বিবরণ তুলে ধরেন ।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ব্যারিষ্টার সারা হোসেন, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ প্রমূখ।
এছাড়া গুম হওয়া সদস্যদের পরিবারের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বনানী থেকে গুম হন বিএনপি নেতা ও সাবেক এমপি ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদী লুনা, গুম হওয়া সদস্যদের পরিবার নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এর প্রধান সমন্বয়কারি আফরোজা ইসলাম, ইসিলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি গুম হওয়া ছাত্র মোকাদ্দেমের চাচা আবদুল হাই, ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি রামপুরা থেকে গুম হওয়া ছাত্রলীগ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন তপুর মা সালেহা বেগম, ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও এর শাহীনবাগ থেকে গুম হওয়া সাজিদুল ইসলাম সুমনে বোন মারুফা আক্তার, ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গুম হওয়া নূর আলমের স্ত্রী রীনা বেগম, চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি গুম হওয়া মুকুলের স্ত্রী জেসমিন আক্তার, চলতি মাসের ৯ তারিখে পার্বত্য এলাকার ইউনাইটেড ওয়ার্কারস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউডব্লিউডিএফ) এর সাধারণ সম্পাদক মাইকেল চাকমা’র বোন সুভদ্রা, ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল যশোর থেকে গুম হওয়া সাঈদের মা হিরা খাতুন, চলতি মাসের ১০ তারিখে রাজধানীর সানারপার থেকে গুম হওয়া ইকবালের স্ত্রীর ভাই মোস্তফা কামাল প্রমূখ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ‘নারী পক্ষ’ সংগঠনের প্রধান শিরিন হক।
অনুষ্ঠানে ড. শাহদীন মালিক বলেন, দিনক্ষণ বলতে পারছি না, তবে প্রতিটি গুম খুনের বিচার এদেশে অবশ্যই একদিন হবে। তিনি বলেন, কেউ আজীবন ক্ষমতায় থাকে না। ১৫ আগষ্ট, জেল হত্যা আর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার যদি ৪৫/৫০ বছর পরে হতে পারে তাহলে গত কয়েক বছরে যেভাবে গুম আর বিচারবহির্ভুত হত্যার ঘটনা ঘটেছে তার বিচারও একদিন হবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
শাহদীন মালিক বলেন, ১৯৭১ সালেও অনেকে গুম হয়েছেন। কিন্ত সেই গুমের সাথে জড়িত ছিল পাকিস্তানি আর্মি। কিন্তু এখন একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীন নাগরিকরা গুম হবেন এটা মেনে নেয়া যায়না। প্রতিটি গুমের বিচার এদেশেই হবে। তবে দিন ক্ষণ বলতে পারছি না। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। তিনি আরো বলেন, গুম খুনের সাথে প্রশাসনের কেউ কেউ জড়িত থাকলেও সবাই জড়িত না। অনেক ভাল কর্মকর্তারা এখন ওএসডিতে আছেন। সময় এক সময়ে আসবে যখন তারাই সঠিক ভুমিকা নেবেন। অন্যায়ের সাথে বা গুম খুনের সাথে জড়িতদের তারাই খুজে বের করে এর বিচার করবেন। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় থাকবো। তবে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের জায়গা থেকে আমাদের কথা বলতেই হবে। আমাদের এই প্রতিবাদই এক সময়ে সমস্বরে প্রতিরোধ হয়ে গুমের বিচারের পথকে সুগম করবে।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, গুম আর খুনের ঘটনায় পুলিশ বা র্যাব যদি অভিযোগ গ্রহণ না করেন তাহলে বুঝতে হবে তারাই এর সাথে জড়িত। তিনি অভিযোগ করে বলেন, দেশের গুম আর খুনের সাথে রাষ্ট্রীয় বাহিনী সরাসরি জড়িত। অথচ সরকার এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করছে। এই সরকার মিথ্যার উপর ভর করে চলছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকারের প্রধান থেকে শুরু করে উচ্চ পদের প্রত্যেকেই গুম খুন নিয়ে অব্যাহতভাবে মিথ্যাচার করছে। গুম পরিবারের অনেক সদস্য অভিযোগ করেছেন, র্যাবের পোশাক পড়েই তুলে নিয়ে পরে গুম করা হচ্ছে । এর জবাবে যদিও র্যাব বলছে, কালো পোশাক নাকি গুলিস্তানেও পাওয়া যায়। তাহলে প্রশ্ন হলো, এই কালো পোশাকের বিক্রেতাকে র্যাব ধরছে না কেন?
তিনি আরো বলেন, জনগনের করের টাকা নিয়ে সেই জনগনের সঙেগই হাসিঠাট্টা করছে প্রশাসনের লোকজন। গুম হওয়া সদস্যের পরিবারের লোকজন যদি থানায় গিয়ে জিডি বা মামলা করতে চান, কিংবা র্যাবের খাতায় অভিযোগ দিতে চান আর সেখানে র্যাব বা পুলিশ যদি অভিযোগ না দিয়ে উল্টো হয়রানি করেন তাহলে বুঝতে হবে এসবের সাথে তারাই জড়িত।
আনু মুহাম্মদ বলেন, দিন বদলের শ্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল। জনগণের মনে এখন প্রশ্ন এটাই কি আওয়ামী লীগের দিন বদল ? পুলিশ র্যাব এখন সারা দেশে আটক বাণিজ্য শুরু করেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। ১৯৭৩/৭৪ সালেও একটি শ্লোগান ছিল স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। এখন সেই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টিও পাচ্ছে না জনগন। তিনি সরকারের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, উন্নয়নের মানে কি প্রতিদিন একজন গুম করা ? উন্নয়নের মানে কি সকালে দুপুরে দুর্ঘটনায় মৃত্যু খবর পাওয়া ? উন্নয়নের মানে কি পাহাড়ে আর সমতলে অস্তিরতা তৈরি করা ?
দেশের নির্বাচনও এখন গুমের মধ্যে পড়ে গেছে এমন মন্তব্য করে আনু মুহাম্মদ বলেন, গুম খুনের বিরুদ্ধে আমরা সর্বদা সোচ্চার ভূমিকা রাখবো। কষ্ট হলেও গুম হওয়া পরিবারের ডাকে সাড়া দেব। আরো বেশি মানুষকে গুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার করতে ভূমিকা রাখতে কাজ করবো।
দীর্ঘ সাত বছর আগে গুম হওয়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদী লুনা অভিযোগ করে বলেন, আমার স্বামীকে ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমার সাথে স্রেফ নাটক করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি অনেকবারই বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মঞ্চে গিয়ে আমার স্বামীর সন্ধান চেয়েছি। আশা করেছিলাম প্রধানন্ত্রী যেহেতু আমাকে কথা দিয়েছেন হয়তো আমার স্বামীকে আমি ফেরত পাবো। কিন্তু পরবর্তীতে মনে হয়েছে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) শ্রেফ একটি নাকট করেছেন।
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদী বলেন, সারা দেশে এখন গুম যেন মহামারি আকার ধারণ করেছে। দেশে তো অনেক দিবসই আছে। তাই তিনি গুমের একটি দিবস ঘোষণা করারও দাবি করেন।
গুমকে তিনি জঘন্যতম মানবতা বিরোধী অপরাধ উল্লেখ করে বলেন, প্রতিটি গুমেরই বিচার হবে। আর যতদিন না আমরা আমরাদের স্বজনদের ফেরত পাচ্ছি ততদিন অন্তত বিচাররের দাবিতে হলেও এভাবে আমাদের কণ্ঠকে উচ্চকিত করেই দাবি জানিয়ে যাব।
উল্লেখ্য ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বনানী থেকে গুম হন বিএনপি নেতা ও সাবেক এমপি ইলিয়াস আলী।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা