সিরিয়াল র্যাপিস্ট শিক্ষক আরিফুলের লাম্পট্যের সাতকাহন
ভিডিও প্রকাশের ভয়ে অনেক অভিভাবক উদ্বিগ্ন- কামাল উদ্দিন সুমন নারায়ণগঞ্জ
- ০৩ জুলাই ২০১৯, ০০:০৫
কেউ লোকলজ্জার ভয়ে চুপ থেকেছেন। আবার কেউ মেয়ের সর্বনাশের কথা জেনে বাসা বদল করে এলাকা ছেড়েছেন। কারো বিয়ে হয়ে গেছে কেউ এখনো অবিবাহিত। এরা সবাই লালসার শিকার হয়েছে লম্পট শিক্ষক আরিফুলের। কাউকে ব্ল্যাকমেইল করে ধর্ষণ করেছে। আবার কারো ধর্ষণের ভিডিও করে তা ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে দফায় দফায় ধর্ষণ করা হয়েছে।
রিমান্ডে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার মিজমিজি কান্দাপাড়া এলাকার অক্সফোর্ড হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক আরিফুল ইসলাম এমন তথ্য দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। ছয় দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ হুমায়ুন কবীরের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীতে ২০-এর অধিক ছাত্রীকে ধর্ষণের কথা শিকার করে বিশদ বর্ণনা দিয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশ পরিদর্শক হাবিবুর রহমান।
গত ২৪ জুন শিক্ষক আরিফুল স্কুলের নবম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। ওই ছাত্রী তার বাবা-মাকে জানালে তারা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় র্যাব -১১কে বিষয়টি জানায়। পরে ২৭ জুন স্থানীয় লোকজন গণধোলাই দিয়ে ওই শিক্ষককে র্যাবের কাছে সোপর্দ করে। আরিফুলের বিরুদ্ধে র্যাব বাদি হয়ে দু’টি এবং এক অভিভাবক বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। এসব মামলায় তাকে ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়ে আসা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষক আরিফুল ছাত্রীদের কাউকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে, কাউকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আবার কাউকে ব্ল্যাকমেইল করে দিনের পর দিন তার শয্যাসঙ্গী করেছে। এর মধ্যে কারো বিয়ে হয়ে গেছে, কেউ অবিবাহিত। আবার কেউ মেয়ের সর্বনাশের বিষয়টি টের পেয়ে গোপনে মেয়েকে নিয়ে এলাকা ছেড়েছেন। আবার অনেকেই ঘটনা টের পেলেও লোকলজ্জার ভয়ে চুপ থেকেছেন।
আর এই সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছে লম্পট আরিফ। শুধু তা-ই নয়, এ ঘটনায় পাঁচ শিক্ষার্থী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। গোপনে আরিফ তাদের ওষুধ খাইয়ে বাচ্চা নষ্ট করেছে। এখানেই শেষ নয়, ঘটনা যাতে প্রকাশ না পায় এ জন্য আপত্তিকর ভিডিও এবং ছবি সংরক্ষণ করে ভুক্তভোগীকে ভয় দেখিয়ে সম্পর্ক বজায় রাখে আরিফ। র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্যই দিয়েছে সে। এ দিকে আরিফের জবানবন্দীতে ধর্ষিতা শিক্ষার্থীদের নাম প্রকাশ পাওয়ার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে অভিভাবক মহলে।
র্যাব, এলাকাবাসী ও কয়েকজন অভিভাবকের দেয়া তথ্য মতে, আরিফের প্রথম শিকার ২০১৪ সালে ৭ম শ্রেণীর এক ছাত্রী। তার সাথে পরিচয় হয় আরিফের এবং ধীরে ধীরে ওই ছাত্রীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। বিভিন্ন সময়ে আরিফ ওই ছাত্রীকে তার ফ্ল্যাটে ১০ থেকে ১২ বার ডেকে নেয়। এর মধ্যে ৪ থেকে ৫ বার শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়। একপর্যায়ে ছাত্রীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সম্পর্ক বজায় রাখে আরিফ। দুইবার ওই শিক্ষার্থীর পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়। অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। পরে দুইবার পিল খাওয়ায় আরিফ। বর্তমানে ওই ছাত্রীর বয়স আঠারো।
আরেক ছাত্রী বর্তমানে বিবাহিত। সে আরিফের দ্বিতীয় শিকার। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে আরিফ। নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন তার সাথে কৌশলে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে আরিফ। এর মধ্যে ২ থেকে ৩ বার ধর্ষণ করে। একপর্যায়ে সেও অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। পরে আরিফ বাসায় তাকে ওষুধ খাইয়ে বাচ্চা নষ্ট করে। তবে ব্ল্যাকমেইলর মাধ্যমে বিয়ের পরও তিন্নির (ছদ্মনাম) সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে আরিফ।
নাসরিন (ছদ্মনাম) বর্তমানে বয়স ১৭। সে অবিবাহিতা। স্কুলে পড়াকালীন তাকে আরিফ ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে এবং স্কুলের তৃতীয় তলায় ছাদে নিয়ে প্রায়ই আলিঙ্গন ও চুমু দিতো। মাঝে মধ্যে তমার বাসায়ও যেত আরিফ। এর মধ্যে দুইবার তমাকে ধর্ষণ করে সে।
১৬ বছরের আরেক ছাত্রীকে ২০১৭ সাল থেকে বাসায় গিয়ে পড়াত আরিফ। এর মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলে অসংখ্যবার ধর্ষণ করেছে সে। এর মধ্যে একবার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। পরে তাকে এমএম কিট ট্যাবলেট খাওয়ায় আরিফ। ২০১৮ সালে যাত্রাবাড়ীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে তার গর্ভপাত ঘটানো হয়।
কে এই লম্পট আরিফুল?
আরিফুল ইসলাম (৩০) মাদারীপুর সদর থানার শ্রীনদী (শিরখাড়া) এলাকার মৃত সিরাজুল ইসলামের ছেলে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে সবার বড়। সিদ্ধিরগঞ্জের পশ্চিম মিজমিজি মাদরাসা রোড এলাকায় বুকস গার্ডেনে ফ্ল্যাট নিয়ে সেখানে সে বাস করত। ২০০৪ সালে মাদারীপুরের হাসানকান্দি ইউনাইটেড উচ্চবিদ্যালয় থেকে সি গ্রেডে (জিপিএ ২.৯৪) এসএসসি পাস করে। ২০০৬ সালে ঢাকার সরওয়ার্দী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। ২০১২ সালে কবি নজরুল কলেজ থেকে বিবিএস ও ২০১৫ সালে গুলশানের মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ (এইচআরএম) পাস করে। তবে ২০০৯ সালে সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজিতে অক্সফোর্ড হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়। বর্তমানে সিনিয়র সহকারী শিক্ষক।
র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরিফ জানায়, ২০০৯ সালে অক্সফোর্ড হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর ২০১৩ সাল পর্যন্ত সুনামের সাথে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত ছিল সে। ২০১৪ সালে প্রথম এক ছাত্রীর সাথে সম্পর্কে জড়ায়। ধীরে ধীরে সম্পর্কের তীব্রতা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে দু’জন দু’জনকে বিয়ে করার চিন্তা করে। পরে আরিফ ওই ছাত্রীর মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি নাকচ করে দেন। এর মধ্যে ওই ছাত্রী মাঝে মধ্যে আরিফের বাসায় যেত। এবং প্রায় ৪ থেকে ৫ বার তার সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়ায় আরিফ। মাঝে একবার ছাত্রীর পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়। পরে বড়ি খাওয়ানোর পর পিরিয়ড আবার শুরু হয়। মেয়ের মা বিয়েতে রাজি না হওয়ায় মেয়েকে নিয়ে এলাকা ছেড়ে যান।
আরিফ জানায়, আরেক ছাত্রী আমার প্রতি পাগল হয়ে যায়। আগের কষ্ট ভোলার জন্য তার সাথে রিলেশন করি। যেটা দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছিল। এর মাঝে ২ থেকে ৩ বার শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হয় আরিফ। একবার অসচেতনাবশত সেক্স করলে পরের দিন ট্যাবলেট খাওয়াই।
আরিফ জানায়, আরো দুই ছাত্রী আমার বাসায় এসে পড়ত। সুযোগ ও সময় পেলে ওদের সাথে শারীরিকভাবে মিলিত হতাম। ২০১৫ সালে বিদ্যালয় থেকে চলে যাওয়ার পর ওদের সাথে আর তেমন দেখা ও কথা হতো না। আরিফ আরো জানায়, এক ছাত্রীর সাথে সম্পর্ক একেবারে অল্প দিনের। ৪ থেকে ৬ মাসের সম্পর্ক। কিন্তু ও আরেক ছেলেকে ভালোবাসত বিধায় আমাকে ছেড়ে দেয়। তবে ওর সাথে ১/২ বার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে। আর একবার বিদ্যালয়ের তৃতীয়তলায় গিয়ে কিছু ছবি তুলি এবং আলিঙ্গন ও কিস করি। ২০১৭ সালের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত এক ছাত্রীর সাথে রিলেশন আছে। আমরা একে অপরকে বিয়ের প্রস্তাব দেই এবং দু’জনেই তাতে রাজি হই। কিন্তু ওর বয়স কম হওয়ায় বিয়ে করা সম্ভব হয়নি। যদিও আমাকে অনেকবার চাপ দেয় সে। এই ছাত্রী আমার বাসায় প্রাইভেট পড়ত। তাই ওর সাথে অনেকবার শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হই। ওকে দুইবার ওষুধ খাওয়াই।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি মীর শাহীন পারভেজ জানান, শিক্ষক আরিফুল আপত্তিকর ছবি তোলে ও গোপন ভিডিও করে ২০ এর অধিক ছাত্রীকে ব্লাকমেইল করে। অনেক ছাত্রীকে একাধিকবার ধর্ষণ করে। ছয় দিনের রিমান্ড শেষে সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে রাজি হয়। পরে মঙ্গলবার তাকে আদালতে নেয়া হয়। জবানবন্দী শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা