০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

এনআরসি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে ভারত

সীমান্তে থেমে নেই পুশ-ইন
-

জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেইÑ ভারতের দেয়া এই আশ্বাসে বাংলাদেশ সরকার আশ্বস্ত হলেও সীমান্তে বাংলাভাষী মুসলিমদের পুশইন থেমে নেই। ভারত থেকে দফায় দফায় বাংলাভাষী মুসলিমদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এসব মানুষের কিছু বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়ছে। কিছু স্থানীয়দের সাথে মিশে যাচ্ছে। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ডামাডোলে এনআরসির আতঙ্ক এখন আসাম থেকে অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। আর তারই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ অভিমুখে ভারতের বাংলাভাষী মুসলিমদের ঢল সহজে থামবে না বলে আশঙ্কা করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। বস্তুত ভারত সরকার বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করার পাশাপাশি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এনআরসি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে।
এ ব্যাপারে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন গতকাল নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে বলেন, ভারত থেকে বাংলাভাষী মুসলিমদের পুশইন চলতে থাকবে। ঢাকা সফরকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এনআরসি ইস্যুতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছিলেন। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের দেয়া এ আশ্বাসে এখনো আশ্বস্ত আছেন। তবে সরকারের বাইরে আমরা যারা রয়েছি, তারা আগেও আশ্বস্ত ছিলাম না, এখনো নই। কেননা নিজেকে মিথ্যা প্রবোধ দিয়ে লাভ নেই। এনআরসি ভারতের বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাভাষীদের ঠেলে দেয়ার চেষ্টা ভারত করে যাবে। তিনি বলেন, এনআরসির পর বাংলাদেশে পুশইন ভারতে বসবাসরত বাংলাভাষী মুসলিমদের উদ্বিগ্ন করে তুলবে। কেননা এই প্রক্রিয়ায় যেকোনো সময় তাদের বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
তৌহিদ হোসেন বলেন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত অনেক মানুষ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে গেছে, ভারত থেকেও অনেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছে। যার যেখানে সুবিধা সেখানে গেছে। এখানে ধর্মটা সব সময় বড় হয়ে দেখা দেয়নি। এখন বিজেপির রাজনীতি হচ্ছে ‘হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তান’। ভোট ব্যাংককে খুশি রাখতে, সমর্থকদের হাতে একটি উত্তেজনাকর ইস্যু তুলে দিতে বিজেপি এই তৎপরতা চালাতে থাকবে। তিনি বলেন, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষায় বিজেপি কাজ করে যাবে। এটা তাদের দিক থেকে যৌক্তিক। তবে এই ইস্যুতে আমাদের নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকাটা যুক্তিবিরোধী। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ইস্যুতে ভারতের আশ্বাস সম্পর্কে সাবেক এই পররাষ্ট্রসচিব বলেন, আশ্বাস এবং তার বাস্তবায়ন দু’টি ভিন্ন বিষয়। ভারত নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। তাই আশ্বাসের বাস্তবায়নও হবে তাদের সুবিধামতো।
গত ৩১ আগস্ট আসামে এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। তালিকায় নাম উঠেছে মোট তিন কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার ৪ জনের। বাদ পড়েছে ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন। এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের মধ্যে ১১ লাখের বেশি হিন্দু বাঙালি রয়েছে। ছয় লাখের কিছু বেশি মুসলমান। বাকি দুই লাখের মধ্যে রয়েছে বিহারি, নেপালি, লেপচা প্রভৃতি। এর আগে আসামে এক কোটি বাংলাদেশী রয়েছে বলে ভারতের অনেক রাজনীতিক দাবি করেছিলেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের সভাপতি অমিত শাহ কেবল আসাম থেকেই নয়, পুরো ভারতে এনআরসি বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দিয়েছেন। অবৈধ বাংলাদেশী বিতারণের ইস্যুটি ভারতের গত কয়েকটি নির্বাচনে বিজেপি জোরালোভাবে উত্থাপন করেছে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের পাশাপাশি দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এনআরসি ইস্যুতে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়কে আশ্বস্ত করেছেন। মোদি বলেছেন, এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু। এটা নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই।
এনআরসি নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেনও। গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটি কোনোভাবেই বাংলাদেশের ওপর প্রভাব ফেলবে না। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে। এনআরসি আতঙ্কে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে ভারত থেকে মানুষ আসার সাম্প্রতিক প্রবণতা সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি আমি গণমাধ্যমে দেখেছি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছু জানি না। তাই এ সম্পর্কে মন্তব্য করা উচিত হবে না। তিনি বলেন, এনআরসি নিয়ে আতঙ্কের কারণ বুঝতে পারছি না।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ভারত থেকে আসা লোকজনকে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করছে কি না জানতে চাইলে আব্দুল মোমেন বলেন, বিজিবির কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো তথ্য পায়নি। এগুলো আমাদের সরকারিভাবে জানতে হবে। তারপর বিষয়টি নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনা করা যাবে। এ ব্যাপারে ভারতের সাথে গতকাল পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো যোগাযোগ হয়নি বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
উল্লেখ্য, গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে হঠাৎ করে ভারত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বেড়ে গেছে। ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তে নভেম্বরের ১০ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত দুই শতাধিক মানুষ ভারত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। গত ২৪ নভেম্বর বেনাপোলের গাতিপাড়া সীমান্তের আমবাগান থেকে পুলিশ ৩২ জন ভারতীয় বাংলাভাষীকে আটক করেছে। এ ছাড়া উত্তর চব্বিশপরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমার সীমান্ত এলাকা থেকে গত ১০ নভেম্বর রাতে ৩৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। আটককৃতরা মুম্বাই, হরিয়ানা ও হায়দরাবাদ এলাকায় থাকতেন। এনআরসি আতঙ্কে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তারা বাংলাদেশে যেতে চেয়েছিলেন বলে ভারতের গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়।
ভারতের কর্নাটন রাজ্যের ব্যাঙ্গালোর থেকে বাংলাদেশী সন্দেহে গত ২৩ নভেম্বর নারী ও শিশুসহ ৫৯ জনকে আটক করা হয়েছিল। এরপর পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা সংলগ্ন হাওড়ার একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে পুলিশ প্রহরায় তাদের আটক রাখা হয়। গত শুক্রবার থেকে তাদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
কথিত ওই বাংলাদেশীদের হাওড়ায় নিয়ে আসার পর থেকে তাদের ওপরে নজর রাখছিলেন স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর। সংগঠনটির সম্পাদক ধিরাজ সেনগুপ্ত বিবিসিকে জানিয়েছেন, শুক্রবার নিশ্চিন্দার ভবনটিতে গিয়ে দেখি সেখানে কেউ নেই। তাদের সীমান্তে ঠেলে দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে এটা আমাদের নিশ্চিত করা হয়েছে।
ভারতের মানবাধিকার সংস্থা মাসুমের প্রধান কিরিটি রায়ের প্রশ্নÑ আটককৃতরা যে বাংলাদেশের নাগরিক, সেটা নিশ্চিত কিভাবে করা হলো? তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য আদালতে তোলা হলো না কেন? তিনি বলেন, ভারতের আইন অনুযায়ী আটক করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনো ব্যক্তিকে আদালতে তোলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
ও দিকে যশোরে বিজিবির কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল সেলিম রেজা বিবিসিকে বলেছেন, ব্যাঙ্গালোর থেকে আটক ৫৯ জনের বাংলাদেশ সীমান্ত পাড়ি দেয়ার কোনো খবর আমাদের কাছে নেই। তবে গত এক সপ্তাহে আমার নিয়ন্ত্রণাধীন সীমান্ত এলাকা থেকে কমপক্ষে ৯জনকে কোনো বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের অপরাধে আটক করা হয়েছে। তিনি জানান, গত এক মাসে এরকম আটকের সংখ্যা কমপক্ষে ৩০ হবে। এ ছাড়া খুলনা, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ সীমান্তেও অবৈধভাবে প্রবেশের জন্য গত কয়েক সপ্তাহে বেশ ক’জনকে আটক করা হয়েছে বলে বিজিবির কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন।
কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন বলেছে, ব্যাঙ্গালোর থেকে আটককৃত কথিত বাংলাদেশী নাগরিকদের কোথায় রাখা হয়েছে এ ব্যাপারে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। ওই ব্যক্তিরা যে বাংলাদেশের নাগরিক, তা নিশ্চিত করার জন্য কন্স্যুলার অ্যাক্সেস দেয়ার কথা। কিন্তু ভারত সরকার যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। তাই বাংলাদেশ মিশন কন্স্যুলার অ্যাক্সেসের জন্য আবেদনও করতে পারেনি।


আরো সংবাদ



premium cement