গ্রাম ও শহরে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের বিপরীত চিত্র
- মেহেদী হাসান
- ৩০ নভেম্বর ২০১৯, ১১:০৩
গ্রাম পর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রে ঘন ঘন সরকারি প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। অনেক স্কুলে রয়েছে শিক্ষার্থী সঙ্কট। অন্য দিকে বিপুল জন অধ্যুষিত ঢাকা মহানগরীতে অনেক বড় এলাকায় আদৌ নেই কোনো সরকারি প্রাইমারি স্কুল। যেসব এলাকায় সরকারি প্রাইমারি স্কুল রয়েছে তার অনেকগুলোতে আবার বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে আগ্রহী নন অনেক শিক্ষিত ও সচ্ছল অভিভাবক। দীর্ঘ দিন ধরে অভিভাবকদের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে রাজধানীর অনেক সরকারি প্রাইমারি স্কুল পরিণত হয়েছে গরিবের স্কুলে। নানা কারণে এখন আর চাইলেও অনেকে এসব স্কুলে সন্তান ভর্তি করানোর সাহস করেন না।
রাজধানীতে বিভিন্ন এলাকায় সরকারি প্রাইমারি স্কুলের সঙ্কট, অনেক স্কুলে মান ও পরিবেশের সঙ্কট এবং অভিভাবকদের নেতিবাচক মানসিকতার কারণে রাজধানীতে প্রাথমিকের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা মূলত পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি খাতে। এর ফলে অভিভাবকদের বিশাল ব্যয়ের বোঝাই শুধু বহন করতে হচ্ছে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা জিম্মি হয়ে পড়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের কাছে। অনেক ক্ষেত্রে বিপুল অর্থ ব্যয় করেও বেসরকারি অনেক স্কুলে সন্তানের মানসম্মত শিক্ষা ও শিক্ষার পরিবেশ থেকে বঞ্চিত অভিভাবকরা। রাজধানীর প্রায় সব বেসরকারি স্কুল আবাসিক ভবনে পরিচালিত হওয়ায় কোমলমতি শিশুরা সেখানে পায় না খেলাধুলার উন্মুক্ত কোনো পরিবেশ। সরকারি স্কুলের সঙ্কটের কারণে বেসরকারি স্কুলেও সন্তান ভর্তি নিয়ে প্রতি বছর অভিভাবকদের অবতীর্ণ হতে হয় ভর্তিযুদ্ধে। রয়েছে নানা ধরনের দুশ্চিন্তা আর হয়রানি।
ঢাকা মহানগরীতে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা ৩৪২টি। ঢাকা শহরে পৌনে দুই কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে এ সংখ্যা কোনো হিসেবের মধ্যে আসে না। তার পরও এসব অনেক স্কুলে রয়েছে শিক্ষার্থী সঙ্কট বিশেষ করে পুরান ঢাকার অনেক স্কুলে। পুরান ঢাকার অনেক এলাকায় স্বল্প দূরত্বে বেশ কিছু সরকারি প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। কিন্তু এসব অনেক স্কুলে শিক্ষার্থী সঙ্কটের মূলে জনসংখ্যার সমস্যা নয়, বরং সমস্যা অন্যত্র। মূলত সচ্ছল ও শিক্ষিত অনেক অভিভাবকদের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে রাজধানীর অনেক এলাকার সরকারি প্রাইমারি স্কুল আগেই গরিব আর নিন্মবিত্তদের স্কুলে পরিণত হয়েছে। এ কারণে এখন আর অনেক শিক্ষিত সচ্ছল পরিবার চাইলেও এসব স্কুলে তাদের সন্তানদের ভর্তি করাতে সাহস করেন না। তাদের অনেকে মনে করেন তাদের সন্তান গরিব আর নিন্মবিত্তদের সন্তানদের সংস্পর্শে এসে খারাপ হয়ে যেতে পারে। তাদের কাছ থেকে ভালো কিছু শিখতে পারবে না। এসব কারণে রাজধানীর অনেক স্কুলে রয়েছে তীব্র শিক্ষার্থী সঙ্কট।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া এলাকার একজন অভিভাবক বলেন, তার এলাকায় একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুল আছে। তারও ইচ্ছা ছিল সন্তানকে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করানো। কারণ তিনি মনে করেন বেসরকারি অনেক স্কুলের শিক্ষকদের তুলনায় সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের মান এখনো অনেক ভালো। সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের শিক্ষক হতে হলে একটি নির্দিষ্ট মান অর্জন করতে হয় এবং পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পেতে হয়। কিন্তু বেসরকারি অনেক স্কুলের শিক্ষকদের তেমন কোনো মান নেই। তা ছাড়া বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর মতো আর্থিক সচ্ছলতাও তার কম। সে কারণে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে সন্তান ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েও তিনি শেষ পর্যন্ত ভর্তি করাতে সাহস করেননি। তার স্ত্রীও রাজি হয়নি। কারণ স্কুলের পরিবেশ সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। বাধ্য হয়ে তাকে অনেক বেশি অর্থ ব্যয়ে বেসরকারি স্কুলে সন্তান পড়াতে হচ্ছে। প্রতি মাসে এক হাজার টাকার ওপরে বেতন ছাড়াও প্রতি বছর পুনঃভর্তি করাতে তার পরিবারের ওপর ভীষণ চাপ চাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারি প্রাইমারি স্কুলের সার্বিক পরিবেশ যদি সন্তোষজনক হতো তা হলে তার সন্তানের লেখাপড়া বাবদ অনেক খরচ কমে যেত।
এক দিকে স্কুল থাকলেও নানা কারণে রাজধানীর অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের সরকারি স্কুলে ভর্তি করান না নানা কারণে; আবার অনেক এলাকায় একেবারেই কোনো স্কুল নেই। যেমন রাজধানীর বনশ্রী এলাকার সাইফুল নামে একজন অভিভাবক জানান, তার দুই সন্তান বেসরকারি স্কুলে প্রাথমিক শাখায় পড়ে। এ জন্য তার প্রতি মাসে শুধু বেতন দিতে হয় তিন হাজার টাকা। আর প্রতি বছর দুই সন্তানের পুনঃভর্তিতে খরচ হয় প্রায় ১৬ হাজার টাকা। আর প্রতি সন্তান ভর্তির সময় খরচ হয়েছে ১৮ হাজার টাকা করে। এ ছাড়া রয়েছে প্রতিদিনের আরো অনেক খরচ। সাইফুল বলেন, এত টাকা খরচ করেও স্কুলের লেখাপড়ায় তিনি সন্তুষ্ট নন। সন্তানদের কাছ থেকে স্কুলের শিক্ষকদের ক্লাসে পাঠদান সম্পর্কে যেসব কথাবার্তা শোনেন এবং সন্তানদের খাতাপত্রে যেসব প্রমাণ রয়েছে, তাতে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে সাইফুলের। তা ছাড়া বেসরকারি প্রায় সব স্কুলই পরিচালিত হচ্ছে আবাসিক ভবন ভাড়া নিয়ে। সেখানে শিশুরা পায় না কোনো খেলাধুলার উন্মুক্ত পরিবেশ। কিন্তু তার পরও বাধ্য হয়ে তিনি তার সন্তানদের এসব স্কুলে পড়াচ্ছেন বিকল্প উপায় না থাকার কারণে। সাইফুল বলেন, আমি সীমিত আয়ের লোক। পরিবারের অনেক খরচ বাঁচিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য খরচ চালিয়ে নিতে হচ্ছে। এলাকায় সরকারি প্রাইমারি স্কুল থাকলে তার খরচ অনেক লাঘব হতো। সন্তানও শিক্ষার ভালো পরিবেশ পেত।
রাজধানীর অনেক এলাকার বিদ্যমান সরকারি প্রাইমারি স্কুলের চিত্র নাজুক হলেও অনেক এলাকায় অনেক সরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের অনেক ভিড় রয়েছে এবং শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের অভিভাবকরা তাদের সন্তানরা এসব স্কুলে ভর্তি করাচ্ছেন।
রাজধানীতে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের তীব্র সঙ্কট থাকলেও দেশের গ্রামের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। অনেক গ্রামে হাঁটা পথে প্রতি ১৫ মিনিট পরপর একটি করে সরকারি প্রাইমারি স্কুল দেখা যায়। অনেক স্কুলে রয়েছে তীব্র শিক্ষার্থী সঙ্কট। কয়েক দিন আগে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া এলাকায় ইউএনও একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে আকস্মিক সফরে গিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কাউকেই পাননি।
বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৯৯টি। ২০১৪ সালে ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল সরকারীকরণ করা হয়। এসব অনেক স্কুলের শিক্ষকদের মান নিয়ে তখন তীব্র প্রশ্ন ওঠে।
সাধারণত গ্রাম পর্যায়ে অনেকে সেবামূলক মনোভাব নিয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং তারা সরকারীকরণের অপেক্ষায় থাকেন। অনেক দানশীল ব্যক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য জমি দান করাসহ নানা কারণে গ্রামে খুব সহজে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং একসময় এসব স্কুল সরকারীকরণ করা হয়। কিন্তু রাজধানীতে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থেকে। সাধারণত আবাসিক ভবন ভাড়া নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এসব স্কুল। এসব স্কুল সরকারীকরণের জন্য তারা প্রতিষ্ঠা করে না এবং সরকারীকরণের কোনো উপায়ও থাকে না। রাজধানীতে জমির অতি উচ্চ মূল্যের কারণে গ্রামের মতো স্কুল প্রতিষ্ঠা সম্ভব হচ্ছে না এবং সেভাবে সরকারিও হচ্ছে না।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় এক হাজার ৫০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের প্রকল্প শেষ হলেও রাজধানীতে হাতেগোনা কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সোহেল আহমেদ বলেন, বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় আরো এক হাজার নতুন বিদ্যালয় স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তবে রাজধানীতে এসব স্কুল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনো অগ্রাধিকার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখে বলতে হবে। ফোনে সব বলা যাবে না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা