২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দেয়ার ঘোষণায় শঙ্কিত অভিভাবকেরা

তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দেয়ার ঘোষণায় শঙ্কিত অভিভাবকেরা - ছবি : নয়া দিগন্ত

প্রাথমিক স্তরে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দেয়ার ঘোষণায় শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা খুশি হলেও বর্তমানে তারা এ নিয়ে শঙ্কিত। তাদের আশঙ্কা বর্তমানে বিদ্যমান দুটি বা তিনটি পরীক্ষা তুলে দিয়ে ক্লাসে মূল্যায়নের নামে এখন সারা বছর শিশুদের ওপর নতুন করে পরীক্ষা পদ্ধতি চাপিয়ে দেয়া হতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিদ্যমান পরীক্ষা তুলে দিয়ে নতুন যে মূল্যায়নের কথা জানানো হয়েছে তাতে অভিভাবকদের মধ্যে পরীক্ষা নিয়ে নতুন দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়েছে।

গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: আকরাম-আল-হোসেন জানান ২০২১ সাল থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দেয়া হবে। গতানুগতিক প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক এবং বার্ষিক পরীক্ষা তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত থাকবে না। সারা বছরেই ক্লাসে মূল্যায়ন করা হবে। শুধু পড়াশোনা নয়, শিক্ষার্থীর আচার-আচরণ সবগুলো বিষয় মূল্যায়ন করে গ্রেড দেয়া হবে। ২০২১ সালে নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু হবে।
ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে দুটি কারণে তারা পরীক্ষা তুলে দেয়া নিয়েও শঙ্কিত। একটি হলো পরীক্ষা তুলে দেয়ার জন্য দীর্ঘ সময় নেয়া এবং পরীক্ষা তুলে দিয়ে তার স্থলে সারা বছর ক্লাসে মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা ।

রাজধানীর দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, আমি আশা করেছিলাম এ বছর থেকেই পরীক্ষা তুলে দেয়া হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দেয়ার জন্য। পরীক্ষা তুলে দেয়া মানে তুলে দেয়া। মানে কোনো পরীক্ষা থাকবে না। একটি বিষয় তুলে দেয়ার জন্য তো দুই বছর সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় দুই বছর সময় নিচ্ছে। তার মানে এটি স্পষ্ট যে, তারা পরীক্ষা তুলে দিয়ে তার স্থলে নতুন কোনো পদ্ধতি চালু করবে। সেটা বৃহস্পতিবারের ঘোষণায়ও স্পষ্ট হয়েছে। সারা বছর মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। সেজন্য নতুন করে কারিকুলাম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নের কথাও বলা হয়েছে। এ থেকে পরিষ্কার যে, শিশুরা আসলে পরীক্ষা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। বরং সারা বছর মূল্যায়নের নামে কোনো পদ্ধতি চালু করা হলে সেটা বর্তমান বছরে দুটি বা তিনটি পরীক্ষার চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। শিশুদের ওপর মানসিক চাপ আরো বাড়তে পারে। এটা তো ঠিক হলো না। আমার কথা হলো প্রধানমন্ত্রী শিশুদের ওপর থেকে পড়ার চাপ কমানো, স্বাধীনভাবে তাদের মেধা বিকাশের কথা বলেছেন। আর বর্তমানে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা অতিরিক্ত পরীক্ষা।

তিনি জানান, তার ছেলে রাজধানীর যে স্কুলে পড়ে সেখানে বছরে দুটি পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। আর সারা বছর থাকে ক্লাস টেস্ট। প্রতি পরীক্ষার আগে একটি বিষয়ে ছয়টি করে ক্লাস টেস্ট নেয়া হয়। তার মানে সারা বছর তাদের পরীক্ষার মধ্যে রাখা হয়। এ পরীক্ষা ঘিরে, পড়া তৈরি নিয়ে সারা বছর শিশুদের মানসিক চাপে রাখতে বাধ্য করা হয় পরিবারের পক্ষ থেকে। পড়া আদায়ের জন্য প্রতিদিন এসব শিশু মা-বাবার হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। এখন যদি প্রচলিত পরীক্ষা তুলে দিয়ে সারা বছর মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা হয় তাহলে একই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এ অভিভাবক।

আরেকজন অভিভাবক বলেন, ক্লাসে মূল্যায়নের যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেটা ভালো। কিন্তু সেটা পরে আর ভালো থাকবে কি না সন্দেহ। কারণ পরীক্ষা বা মূল্যায়ন মানেই হলো মা-বাবা সন্তানদের নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া। এ প্রতিযোগিতার কারণেই শিশুদের ওপর তারা চাপ সৃষ্টি করে। সে কারণে সবচেয়ে ভালো হয় তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোনো ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতি বা মেধা তালিকা না রাখা। কেবল তাহলেই শিশুরা মুক্তি পাবে পড়া নামক বর্তমান নিপীড়ন ব্যবস্থা থেকে। তারপরও যদি সরকার মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখতে চায় তাতেও বর্তমান পাঠ্যবই থেকেই তা সম্ভব। আর এ ক্ষেত্রে শুধু ক্লাস ওয়ার্ক নয় হোমওয়ার্ক অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ক্লাসে মূল্যায়ন পদ্ধতি কমিয়ে আনা ভালো। আর ক্লাসে মূল্যায়ন যেন ঘন ঘন না হয় সেটিও নিশ্চিত করা দরকার।
কয়েকজন অভিভাবক বলেছেন, নতুন কারিকুলাম নতুন পাঠ্যবই প্রণয়ন মানেই শিশুদের ওপর নতুন করে কিছু আরোপ হতে যাচ্ছে। আর নতুন পদ্ধতি মানেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবার জন্যই ভোগান্তি। সে কারণে অনেক অভিভাবক জানিয়েছেন এতসব ঝামেলায় না গিয়ে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পূর্ণ তুলে দেয়া উচিত। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত মেধা তালিকা না থাকলে তেমন কোনো অসুবিধা হবে না। তবে কয়েকজন অভিভাবক বলেছেন, মূল্যায়ন ও মেধা তালিকা একেবারেই না থাকলে শিশুদের পড়ালেখা একেবারে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তার মানে সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেজন্য পরীক্ষা নয় হোমওয়ার্ক ও ক্লাসওয়ার্কভিত্তিক কোনো মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে চালু ক্লাসওয়ার্ক ও ক্লাস টেস্ট ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে শিশুদের জন্য উপযুক্ত একটি পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। তার নামকরা কোনো স্কুলের কোনো পদ্ধতি হুবহু গ্রহণ না করাই ভালো। কারণ নামকরা স্কুলে শিশুদের জন্য পড়ালেখা অতি কঠিন এবং ভারী। ক্লাস টেস্টের নামে তারা সারা বছর শিশুদের পরীক্ষার জালে আটকে রাখে।

গত মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে পড়ার জন্য শিশুদের অতিরিক্ত চাপ না দিতে শিক্ষক অভিভাবক সবার প্রতি জোর অনুরোদ জানান। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে আমি এটুকুই বলব, কোনোমতেই যেন কোমলমতি শিশুদের অতিরিক্ত চাপ না দেয়া হয়। শিশুরা যেন হাসতে খেলতে মজা করতে করতে পড়াশোনাটাকে নিজের মতো করে করতে পারে সেই ব্যবস্থাটাই করা উচিত। সেখানে অনবরত ‘পড়’, ‘পড়’, ‘পড়’ বলাটা বা ধমক দেয়াটা বা আরো বেশি চাপ দেয়া হলে শিক্ষার ওপর তাদের আগ্রহটা কমে যাবে, একটা ভীতির সৃষ্টি হবে। শিক্ষার প্রতি সেই ভীতি যেন সৃষ্টি না হয়, সেজন্য আমি আমাদের শিক্ষক এবং অভিভাবকদের অনুরোধ করব।

এরপর মার্চ মাসেই মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় আগামী শিক্ষা বছর থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়া হবে। কয়েক দিন পর আবার মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় এ বছর থেকেই পরীক্ষা তুলে দেয়া হচ্ছে। এতে আশাবাদী হয়েছিলেন শিশুদের পড়ালেখা আর পরীক্ষা নিয়ে বিড়ম্বনার শিকার রাজধানীর অনেক অভিভাবক।


আরো সংবাদ



premium cement