খাল পুনঃখনন প্রকল্প : প্রতি টেবিলের দাম ৫০ হাজার টাকা, চেয়ার ১৫ হাজার
- হামিদ সরকার
- ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:০০, আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৩:৪৬
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে বালিশকাণ্ডের পরও উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়ে মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলো আজো সংযত হয়নি। বিভিন্ন প্রকল্পে এখনো একের পর এক অস্বাভাবিক ব্যয়ের ঘটনা ঘটছে। কেরানীগঞ্জে খাল পুনঃখনন প্রকল্পে ৩৬টি খাতে ১৬৪টি টেবিল ও চেয়ার কেনা হবে। যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩ লাখ টাকা। এখানে টেবিলের দর ৫০ হাজার টাকা এবং চেয়ারের দর ১৫ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। অন্য দিকে প্রতি কিলোমিটার স্লাস অপসারণেই ব্যয় হবে ১৭ কোটি টাকার বেশি। বাধ্যবাধকতা থাকলেও এক হাজার ২৯০ কোটি ৯৩ লাখ টাকার এই প্রকল্পে কোনো সমীক্ষা করা হয়নি বলে পরিকল্পনা কমিশনের সেচ উইং সূত্রে জানা গেছে। পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মো: জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, সমীক্ষা ছাড়া কোনো প্রকল্প পিইসি থেকে অনুমোদন দেয়া হবে না। আর প্রতিটি খাতের ব্যয় যথাযথভাবে যাচাই করা হবে।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা খাল ও খালের পাড় সুরক্ষা এবং উন্নয়নের জন্য এক হাজার ২৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনঃখনন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। খালের অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরায় চালু করা হবে। স্থানীয় জনগণের জন্য খালের পাড়ে বিনোদনমূলক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হবে। তিন বছরের এই প্রকল্পের পুরো অর্থায়নই হবে সরকারি তহবিল থেকে। এই খালে কঠিন ও তরল বর্জ্য নিক্ষেপসহ খালের পাড়ে অবৈধভাবে বাড়িঘর, দোকানপাট, কলকারখানা ও মসজিদ গড়ে উঠেছে। ফলে শুভাঢ্যা খালের প্রস্থ ও গভীরতা কমে গেছে। নিষ্কাশিত বর্জ্যরে কারণে খালের পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। প্রকল্পের মূল কাজ হলো ১৩.৮ কিলোমিটার স্লাস অপসারণ, ২.৬ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, ২.০৮ কিলোমিটার খালের পাড় সংরক্ষণ এবং ৬১.৯৪ একর ভূমি অধিগ্রহণ। ভাসমান ও ভূপৃষ্ঠের চলার পথ ২২.৬৭৩ কিলোমিটার, পাঁচটি পয়ঃডাইভারশন স্ট্রাইকার নির্মাণ, ওয়াকওয়ে ও সেতু লাইটিং, মাঠঘাট ও হাট উন্নয়ন, খাল পাড়ে বিদ্যমান অবকাঠামো উন্নয়ন, প্লাজা নির্মাণ ছয়টি এবং পরামর্শক নিয়োগ।
ব্যয় বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, প্রকল্পে বিভিন্ন পদে জনবলের জন্য ১৬৪টি আইটেমের টেবিল ও চেয়ার কেনা হবে। তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৩ লাখ টাকা। এখানে প্রকল্প পরিচালকের টেবিলের দাম ধরা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা এবং তার চেয়ারের দর সাড়ে ১৭ হাজার টাকা। পরামর্শকের বেতন ধরা হয়েছে মাসে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। আর তাদের টেবিলের দাম ৪০ হাজার টাকা ও চেয়ারের দাম ১৫ হাজার টাকা। ভিজিটরদের চেয়ারের দাম ১০ হাজার টাকা। প্রকৌশলীদের টেবিল প্রতিটি ৪০ হাজার টাকা, চেয়ার ১৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য কর্মকর্তার টেবিল প্রতিটি ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং চেয়ার সাড়ে সাত হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা।
প্রকল্পে ১৩.৮ কিলোমিটার খাল থেকে স্লাস অপসারণের জন্য ২৩৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ১৭ কোটি ৫৭ হাজার ৯০০ টাকা। যা নদী খননের চেয়েও বেশি। কপোতাক্ষ নদের ড্রেজিং খরচ কিলোমিটারে ১.২৯ কোটি টাকা, শালিখা নদের ৩.৬০ কোটি টাকা এবং ভৈরব নদীর ২.১৭ কোটি টাকা। আর ২.০৮ কিলোমিটার খালের পাড় সংরক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪ কোটি ২২ লাখ টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ১৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
এদিকে প্রতি কিলোমিটার ভাসমান ও ভূপৃষ্ঠের চলার পথ নির্মাণ খরচ ছয় কোটি ৫৯ লাখ টাকা। পাঁচটি পয়ঃডাইভারশন স্ট্রাইকার নির্মাণে প্রতিটির খরচ ২৭ কোটি ৯৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। পূর্ত কাজের ডিজাইন ও সুপারভিশনের জন্য ১০ জন পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হবে। ৩৬ মাসে তাদের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯ কোটি ৮৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। ফলে জনপ্রতি প্রতি মাসে বেতন হবে ছয় লাখ ৬৩ হাজার টাকার বেশি। পানি উন্নয়ন বোর্ডে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল রয়েছে। তাদেরকে দিয়ে এই কাজ করানো যেতে পারে। তাই পরামর্শক খাতটি বাদ দেয়ার জন্য সেচ উইং মতামত দিয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সেচ উইংয়ের যুগ্ম প্রধান বলছেন, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত কাজগুলো যেমন খাল পুনঃখনন, বাঁধ নির্মাণ, খালের পাড় সংরক্ষণ ইত্যাদি পানি উন্নয়ন বোর্ড করতে পারে। অন্যান্য কাজ স্থানীয় সরকার বিভাগ বা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যৌক্তিক হবে। বিধান অনুযায়ী ২৫ কোটি টাকার বেশি কোনো বিনিয়োগ প্রকল্প হলে তার জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই বা সমীক্ষা করাটা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই প্রকল্পে সেটা করা হয়নি। আয়-ব্যয় বিশ্লেষণও করা হয়নি। পাশাপাশি কারিগরি কমিটি কর্তৃক প্রকল্পের বিভিন্ন কার্যক্রমের পরিমাণ ও ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাও হয়নি। প্রকল্পের আওতায় দুই হাজার ৬০০টি গাছ রোপণ করা হবে। যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। এই ব্যয় ১০ লাখ টাকায় কমিয়ে আনা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। প্রকল্পের অনেক ব্যয়ের খাত বাদ দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
প্রকল্প ও প্রস্তাবিত খরচের ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মো: জাকির হোসেন আকন্দের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, সমীক্ষা ছাড়া কোনো প্রকল্পই হবে না। আমরা তাদেরকে দিয়ে সমীক্ষা করিয়ে আনব। প্রকল্পের ব্যাপারে যেসব বিধিবিধান আছে তা অবশ্যই পালন করতে হবে। তিনি বলেন, বালিশ কেসের মতো এখানে কোনো ব্যয় হতে দেয়া হবে না। ফলে তারা যে দরই দিক না কেন তা বাজারের সাথে যাচাই করেই করা হবে। আর প্রকল্পে পূর্তের কাজ অবশ্যই রেট শিডিউলের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়গুলো বেশি দরে পাঠায়। তারা জানে পিইসিতে এসে সেগুলো কেটে বাস্তব ও যৌক্তিকপর্যায়ে নিয়ে আনা হয়।