২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

প্রবাসী শ্রমিকরা সমস্যায় জর্জরিত ৭ লাখের মধ্যে ৪ লাখই সৌদিতে

প্রবাসী শ্রমিকরা সমস্যায় জর্জরিত ৭ লাখের মধ্যে ৪ লাখই সৌদিতে - ছবি : সংগৃহীত

২০১৯ সালে স্মার্টকার্ড নিয়ে পৌনে এক লাখ নারী কর্মীসহ সাত লাখ শ্রমিক বৈধভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এরমধ্যে চার লাখ শ্রমিকই আছেন মধ্যেপ্রাচ্যের অন্যতম শ্রমবান্ধব দেশ সৌদি আরবে। বাকি তিন লাখের মধ্যে কাতার, ওমান ও সিঙ্গাপুরে কর্মী যাওয়ার গতি ভালো থাকলেও বাহরাইন, মালয়েশিয়া, মিসর, মালদ্বীপ, ব্রুনাই, মরিশাসসহ অন্যান্য দেশে এক হাজার শ্রমিকও পাঠাতে পারেনি জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো।

এসব দেশের মধ্যে ব্রুনাই, মালদ্বীপসহ কয়েকটি দেশে ফলস ডকুমেন্টের (জাল জালিয়াতি) মাধ্যমে কর্মী যাওয়ার (অসত্যায়িত ভিসায়) অভিযোগ অনেক পুরনো। এসব শ্রমিকের বেশির ভাগই কাকরাইল এলাকায় গড়ে ওঠা চিহ্নিহ্নত ১২ সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই গেছে এবং এখনো যাচ্ছে বলে জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরো ও কাকরাইল এলাকার চিহ্নিহ্নত দালালদের মুখে মুখে বিষয়টি আলোচিত রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের সাথে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ থাকার অভিযোগ রযেছে। যার কারণে সৌদি আরব, মালদ্বীপ, ব্রুনাই, কাতারসহ অন্যান্য দেশে যাওয়া কর্মীদের অনেকে চুক্তি মোতাবেক বেতনভাতা ঠিকমতো পাচ্ছেন না, উল্টো পুলিশি হয়রানি আর অভিযানে আটক হওয়ার ভয়ে পালিয়ে থাকাসহ নানা সমস্যায় তাদের জর্জরিত থাকতে হচ্ছে। এর ফলে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সৌদি আরবে যাওয়া কর্মীর মধ্যে ২৫ হাজারেরও বেশি শ্রমিক ইতোমধ্যে আকামা জটিলতা, নিয়োগকর্তার নারী শ্রমিক নির্যাতনসহ নানা অভিযোগে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা খালি হাতে দেশে ফিরেছেন, তাদের অভিযোগুলো যদি জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো থেকে মাঠপর্যায়ে (দূতাবাসের কথা আলাপ করে) সঠিক এবং সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করত তাহলে অনেক নির্যাতিত শ্রমিক ক্ষতিপূরণের টাকা পেতেন; কিন্তু বেশির ভাগ ঘটনায় ব্যুরোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নানা কৌশলে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের পক্ষ নিয়ে তদন্ত করায় শ্রমিকরা তাদের নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। অপর দিকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই আঙুল ফুলে কলাগাছ বনেছেন। বিষয়টি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ গোপনে অনুসন্ধান করলেই জানতে পারবেন বলে তারা মনে করছেন।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যার পর জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক সামছুল আলমের সাথে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয়; কিন্তু দু’বার তাকে টেলিফোন করার পরও তিনি টেলিফোন ধরেননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালে সাত লাখ ১৫৯ জন শ্রমিক বৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমান। এরমধ্যে সর্বোচ্চ তিন লাখ ৯৯ হাজার কর্মী যান সৌদি আরবে। এরমধ্যে নারী কর্মী ৬২ হাজার ৫৭৮ জন। বিদেশে যাওয়া কর্মীর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ওমান। দেশটিতে গেছে ৭২ হাজার ৬৫৪ জন। এরপরের অবস্থানে আছে কাতার। সেখানে আছে ৫০ হাজার ২৯২ জন। আর চতুর্থ অবস্থানে আছে সিঙ্গাপুর। গত এক বছরে দেশটিতে গেছে ৪৯ হাজার ৮২৯ জন।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, হাতেগোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া বাকি দেশগুলোতে কর্মী যাওয়ার হার হতাশাব্যঞ্জক। এরমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে মাত্র তিন হাজার ৩১৮, বাহরাইনে ১৩৩ জন, মালয়েশিয়ায় ৫৪৫ জন, মিসরে একজন, ব্রুনাইয়ে ২৫৫ জন, মরিশাসে ৬৪৪ জন। এ ছাাড় জাপানসহ অন্যান্য দেশে যাওয়ার হার আরো কম।
অপর দিকে ২০১৮ সালে সাত লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ জন শ্রমিক বিদেশে গেছেন। এরমধ্যে দুই লাখ ৫৭ হাজার ৩১৭ জন গেছে সৌদি আরবে। এরমধ্যে আবার মহিলা আছে এক লাখ এক হাজার ৬৯৫ জন। যদিও ২০১৭ সালে আগের প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি দায়িত্বে থাকার সময় সর্বোচ্চ ১০ লাখ আট হাজার ৫২৫ জন গিয়েছিলেন। এটিই বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানির সর্বোচ্চ রেকর্ড।

গতকাল শুক্রবার রাতে ঢাকার একজন প্রবীণ জনশক্তি রফতানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, সৌদি আরবের নামসর্বস্ব কোম্পানি থেকে ভিসা নেয়ার কারণে দেশটিতে শ্রমিক যেমন বেশি যাচ্ছে তেমনি শ্রমিকদের সমস্যাও বেশি হচ্ছে। দুই দেশ থেকে যে পর্যন্ত মিডলম্যান (দালাল) না কমবে সে পর্যন্ত শ্রমিকদের সমস্যা কমবে না বাড়তেই থাকবে। আর ফেরত আসার সংখ্যাও বাড়বে। এক প্রশ্নের উত্তরে ওই ব্যবসায়ী বলেন, সৌদি আরবে ভালো কোম্পানিতে কম অভিবাসনে (সর্বোচ্চ এক লাখ) কর্মী গিয়েও ভালো থাকছে। আর সাড়ে তিন লাখ টাকায় যেসব কর্মী যাচ্ছে তারাই বেতনসহ নানান বিপদে আছে।

অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের সরকারের পলিসি পরিবর্তন করতে হবে। সরকার চাচ্ছে দালালনির্ভরতা কমাতে; কিন্তু আমাদেরকে শ্রমিক সংগ্রহের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে দিচ্ছে না। তাহলে কিভাবে লোক সংগ্রহ করব আমরা। তার মতে, আমাদের কাছ থেকে সরকার জামানতের টাকা প্রয়োজনে আরো বাড়িয়ে নিক; কিন্তু অভিবাসন আইন আরো সহজ করুক। নতুবা এই সেক্টর থেকে কখনোই ভালো কিছু আশা করা যাবে না।

এ দিকে জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরো নিয়ে কাজ করছেন এমন একাধিক ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি নাম না প্রকাশের শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, এখনো মালদ্বীপ, ব্রুনাইসহ কয়েকটি দেশে আনডকুমেন্টেড কর্মীকে নানা কৌশলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে বলে শুনছি। এরসাথে ব্যুরোর বহির্গমন শাখার কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ আছে। অপর দিকে কাকরাইলের জনশক্তি ব্যুরোর কর্মসংস্থান শাখার সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার দু’জন কর্মকর্তা রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো সঠিকভাবে যাচাই না করেই প্রায়ই প্রতিবেদন তৈরি করছেন। এ নিয়ে প্রায় ওই কর্মকর্তাদের সাথে তাদের দফতরে প্রতারিত শ্রমিকদের কথাকাটাকাটি হচ্ছে।

গতকাল বিমানবন্দর প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের একজন কর্মকর্তা জানান, সৌদি আরব থেকে নির্যাতিত নারী-পুরুষ শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত দেশে ফিরছেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের দু’টি ফ্লাইটে ১০৯ জন শ্রমিক খালি হাতে দেশে ফেরত আসেন। এর আগে জেদ্দার কনসাল জেনারেল অফিসের কাউন্সেলর (শ্রম) আমিনুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেছিলেন, সৌদি সরকার অবৈধ সৌদি মুক্তকরণ নামের যে কর্মসূচি চালু করেছে তারই ধারাবাহিকতায় হাজার হাজার বিদেশী অবৈধ শ্রমিক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দেশটির ডিটেনশন সেন্টার ও জেলখানায় আছে। ফ্রি টিকিট পেলেই তাদের নিজ নিজ দেশের বিমানের ফ্লাইটে তুলে দেয়া হবে। তবে তিনিও স্বীকার করেন নামসর্বস্ব কোম্পানির কারণে এখানে অনেক শ্রমিক এসে বিপদে আছে। অনেকে এসেছে দূতাবাসের ক্লিয়ারেন্স ছাড়াই।


আরো সংবাদ



premium cement