২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দুঃসহ স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় শিল্পীকে

শিল্পী আক্তার - ছবি : সংগ্রহ

‘সব কিছু যেন ভেঙে গায়ে পড়ছে। প্রায়ই রাতে ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে উঠি। সেই দিনের কথা মনে পড়লে আজো শরীর শিউরে ওঠে। ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে অন্ধকারে তিন দিন, তিন রাত চাপা পড়েছিলাম। বের হওয়ার সুযোগ ও সাধ্য কোনোটাই ছিল না। চিৎকার দিলেও কেউ শোনেনি। ক্ষুধা আর চাপা পড়া হাতের যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম।’ 

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে হাত হারানো গার্মেন্টস শ্রমিক শিল্পী আক্তার এভাবেই তুলে ধরেন মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া সেই দুঃসহ দিনের স্মৃতি। সেই স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। ঘুমের ঘোরেও পিছু ছাড়ে না সে দুঃস্বপ্ন। 

শিল্পীর বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার তারাইল গ্রামে। স্বামী-সন্তান নিয়ে জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় যান। পরে সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতনে সাভারের রানা প্লাজার চতুর্থ তলায় ফ্যানটম ট্যাক লিমিটেড পোশাক কারখানায় ফিনিশিং হেলপার হিসেবে কাজ নেন। দুর্ঘটনার ছয় মাস আগে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ভবন ধসের আগের দিন তার স্বামী অসুস্থ থাকার কারণে ডিউটি করতে যাননি। প্রতি মাসের ২৪ তারিখে ওভারটাইমের বেতন শিট তৈরি করা হয়। তাই সবার মতো শিল্পীও সে দিন অসুস্থ স্বামীকে বাসায় রেখে হাজিরা দিতে কাজে গিয়েছিলেন; কিন্তু সব কিছুই যেন ওলট-পালট হয়ে যায়। 

সেই দুঃসহ দিনের কথা মনে করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে শিল্পী আক্তার বলেন, ‘অন্যান্য দিনের মতো, সে দিন অফিসে গিয়েছিলাম। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। বিকট শব্দ শুনতে পাই। কিছুক্ষণ পর ঝাঁকুনি দিয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধসে পড়ে ভবন। আস্তে আস্তে হাতের উপর অনুভব করি ভারী কোনো বস্তুর উপস্থিতি। ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসে নিঃশ্বাস। কয়েক ঘণ্টা পর চাপাপড়া হাতে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। ব্যথার যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকি। অন্ধকারে চার দিকে শোনা যায় শুধু মানুষের বাঁচার আকুতি। দু’দিন পরেই নাকে আসে পচা লাশের প্রচণ্ড দুর্গন্ধ। এভাবে বিনা খাবারে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে মেশিনের নিচে ৭২ ঘণ্টা চাপা পড়েছিলাম। ডান হাত মেশিনের নিচে পড়ে থেঁতলে যায়। তিন দিন পর উদ্ধারকর্মীরা কাছে গিয়ে বলেন হাত কেটে বের করতে হবে। প্রথমে আমি রাজি না হলেও, পরে রাজি হই। তিন দিন পর আমাকে উদ্ধার করে সাভার সেনানিবাস হাসপাতালে ভর্তি করেন উদ্ধারকর্মীরা।’ 

গতকাল শিল্পী আক্তারের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ডান হাত হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। এক হাত দিয়েই রান্নাবান্নাসহ সংসারের যাবতীয় কাজ করছেন। এখনো তার শরীরে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। নিয়মিত খেতে হয় ওষুধ। সরকারের পক্ষ থেকে শিল্পী ১০ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র পেয়েছেন। সেখান থেকে প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার টাকার মতো পান এবং অসুস্থ স্বামী মো: ওহিদ বিশ্বাস বাড়ির পাশে একটি মুদি দোকান নিয়ে বসেছেন। তা দিয়েই কোনো মতে চলছে শিল্পীর সংসার ও তিন ছেলেমেয়ের লেখাপড়া এবং নিজের ওষুধ কেনা।


আরো সংবাদ



premium cement