২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ঘর থেকে উঠানো হলো ২ কোটি টাকার সোনার কলস!

ঘর থেকে উঠানো হলো ২ কোটি টাকার সোনার কলস! - সংগৃহীত

‘ঘরের রয়েছে দু’টি সোনার কলস। সেখানে পাওয়া যাবে ২ কোটি টাকার সোনা। তবে তিন কান হলে ( ৩য় জন জানলে) সব বিফলে যাবে।’ ভন্ড ফকিরের এমন প্রতারণার ফাঁদে পড়ে গত ৮ মাস যাবত আব্দুল বারেক সরদার নামে এক ব্যক্তি খুঁইয়েছেন প্রায় ২০ লাখ টাকা। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর আজ শনিবার সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে উদ্ধার করা হয়েছে সোনালী রঙের জোরি মাখানো মাটির দলা সহ পিতলের দু’টি খালি কলস। এ ঘটনায় যুক্ত প্রতারক ওই ভন্ড ফকিরকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। ঘটনাটি এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।

আটক এই ভন্ড ফকিরের নাম ইছহাক প্রামানিক ওরফে ইছহাক ফকির (৪০)। বাড়ি ফরিদপুরের সদর উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের শ্যামসুন্দরপুর গ্রামে। সেখানে ফকিরী আস্তানা গড়ে প্রায় এক যুগ যাবত এভাবে সে অলৌকিক ক্ষমতার ফাঁদ পেতে প্রতারণা ব্যবসা চালিয়ে আসছিলো। জ্বীনের পাশাপাশি তার এই আস্তানায় চলে কালি দেবীর সাধনাও। তার এই অপকর্মে অন্যতম এক সহযোগী নিতাই কুমার ওরফে নাইতা (৪০) নামে আরেক প্রতারক অবশ্য ঘটনার পর পালিয়েছে।

এলাকাবাসী জানান, ইছহাকের এই ভন্ডামীর আস্তানায় প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে চলে বার্ষিক ওরসের আয়োজন। বহু অপকর্মের নায়ক এই ভন্ড ইছহাক প্রামানিক মাত্র মাস দেড়েক আগে শহরের ‘নিউ গার্ডেন সিটি’ নামে একটি আবাসিক হোটেল থেকে আটক হয়। অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অপরাধে ভ্রাম্যমান আদালতে ১৫ দিনের সাজা প্রদান করেন। তার অন্যতম সহযোগী নিতাই কুমার নাইতাকে গ্রেফতারের জোর দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী

অপরদিকে সোনার কলসের ফাঁদে প্রতারিত ওই ব্যক্তির নাম আব্দুল বারেক সরদার (৫০)। বাড়ি ফরিদপুরের সীমান্তবর্তী রাজবাড়ি জেলার সুলতানপুর গ্রামে। তার বাড়ি থেকেই ভন্ড ইছহাককে আটক করে নিয়ে আসে এলাকাবাসী।
আব্দুল বারেক সরদার সাংবাদিকদের জানান, শনিবার দুপুরেও ভন্ড ফকির ইছহাক তার বাড়িতে এসে জানায় যে, আসছে পুর্ণিমাতেই সোনায় কলস ভরে যাবে। কিন্তু তার সন্দেহ হচ্ছিলো। অনেক টাকা খুইয়ে ফেলেছেন এরই মধ্যে। স্ত্রী সন্তানেরা অধৈর্য হয়ে পড়েছিলো। অনেক ধারদেনা করে টাকা জোগাড় করেছি। পাওনাদারদের চাপে আর পারছিলাম না।

তিনি জানান, গত ৮ মাস আগে থেকে এই সোনার কলসের কাহিনী শুরু। বাড়িতে এসে বাঁশ ঝাড়ের নিকট প্রসাব করতে যায় ইছহাক। তখনই তাকে ডেকে জানায়, এখানে ‘গুপ্ত মাল’ আছে! কি মাল আছে? জানতে চাইলে ইছহাক তাকে জানায়, দু’টি সোনার কলস। প্রায় ২ কোটি টাকার ব্যাপার! তবে এই কলস উঠাতে হলে অনেক টাকা লাগবে।
ইছহাকের এমন কথায় লোভে পড়ে যান বারেক সরদার। প্রথম দফাতেই তিনি তার হাতে তুলে দেন ৩২ হাজার টাকা। এরপর গত ৮ মাস যাবত ২০ লাখ টাকা দেন। সোনার কলসের কথা তিন কান করে পাশের গ্রামের বজলু নামে এক লোক মারা গিয়েছে বলেও ভয় দেখায় ইছহাক। এজন্য কাউকে বলিনি। জানান বারেক সরদার।

ভন্ড ইছহাকের সোনার কলসের এমন আজগুবি কথার উপড়ে আপনার ভরসা এলো কিভাবে? জানতে চাইলে বারেক সরদার বলেন, ৭ বছর আগের কথা। তার দেড় বছরের নাতি শিহাব থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত ছিলো। মাঠে কাজ করতে যেয়ে পরিচিত এক দিনমজুরের মাধ্যম জানতে পানের ইছহাক ফকিরের কথা। শিহাবকে চিকিৎসার জন্য সেখানে নিয়ে যান। ইছহাকের ঝাড়ফুঁক আর কবিরাজি ওষুধ দিয়ে গত ৭ বছর শিহাবের চিকিৎসা চলছে। তাকে আর রক্ত দিতে হয়নি। সেজন্য ওর প্রতি একটা আস্থা তৈরি হয়।

বারেক সরদার জানান, ভন্ড ইছহাকের ফাঁদে তিনি মাঠের ৪০ শতক জমি ও হালের একটি বলদ বিক্রি করে ১০ লাখ আর সুদে টাকা এনে ১০ লাখ টাকা জোগাড় করেন। এখন সুদে আনা টাকা প্রতিমাসে ২ লাখ টাকা করে বাড়ছে। কিস্তিতে আনা এক লাখ টাকার জন্য প্রতিমাসে তাকে কিস্তি দিতে হচ্ছে ৮ হাজার টাকা করে। ভিটে বাড়িটিও এখন বন্ধক দেয়া। এখন কিভাবে এই টাকা উদ্ধার করবেন সেটা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেন না।

বারেক সরদারের ছেলে মতিউর রহমান গাজিপুরের বদরে আলম ভাওয়াল কলেজের মাস্টার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। তিনি জানান, আমরা ইছহাকের আশ্বাসে স্থির ছিলাম। তাই কাউকে বলিনি। তবে এখন দেখছি সে আমাদের পথের ফকির করে ছেড়েছে। আমরা এর বিচার চাই।

সাংবাদিদের জিজ্ঞাসাবাদে চতুর ইছহাক অবশ্য সহসাই মুখ খুলেনি। তবে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাদের একপর্যায়ে সে স্বীকার করেছে যে, বারেক সরদারের নিকট থেকে সে এই সোনার কলসের কথা বলে ১৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ফকিরী আস্তায় সে কবিরাজী ব্যবসা করতো বলে জানায়। এসময় খবর পেয়ে তার স্ত্রী রুবিনাও সেখানে হাজির হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একটি তালাবদ্ধ টিনের চালা ঘর। ঘরে ঢুকে দেখা যায় এক কোনে দু’টি পিতলের কলস। কলসের মুখে কাপড় মোড়ানো। উপড়ে দু’টি কড়ি বসানো। এই কলসেই সোনা পাওয়া যাবে বলে গত ৮ মাস যাবত প্রতারণা করে আসছিলো ভন্ড ফকির।

এব্যাপারে কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার শেখ শহিদুল ইসলাম শহিদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ইছহাক প্রামানিককে প্রতারণার অভিযোগে বারেক সরদারের বাড়ি থেকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন যাবত সে শ্যামসুন্দরপুর গ্রামে আস্তানা গেড়ে ঝাড়ফুঁক ও কবিরাজির চিকিৎসা করে আসছে।
কোতয়ালী থানার এস আই সুকুমার ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, ইছহাক প্রামানিককে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে বারেক সরদার বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন।


আরো সংবাদ



premium cement