কাপাসিয়ায় প্রচারে এগিয়ে আ’লীগ, কৌশলে বিএনপি
- মোহাম্মদ আলী ঝিলন, গাজীপুর থেকে
- ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৮:৫৫
শনিবার রাত পোহালেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে গাজীপুর-৪, কাপাসিয়া আসনে মোট ৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করলেও মূল লড়াই হবে কাপাসিয়ার আলোচিত বড় দুই দলের নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী দুই ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যের মাঝেই।
এদের একজন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ এর মেঝো মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি। অপরদিকে বিএনপি মনোনীত দলের স্থায়ী কমটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসম হান্নান শাহর পুত্র শাহ্ রিয়াজুল হান্নান।
দুই দলের প্রার্থীর ভরসাই হলো তাদের প্রয়াত পিতার ইমেজ। মাঠের প্রচার-প্রচারনায় এগিয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী সিমিন হোসেন রিমি। কিন্তু হামলা-মামলায় জর্জরিত হয়ে কৌশলে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন বিএনপি দলীয় প্রার্থী শাহ্ রিয়াজুল হান্নান।
ইতোমধ্যে সাধারণ ভোটাররা তাদের ভোটের হিসাব কষতে শুরু করেছেন। বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে জেল-জুলুম, হুলিয়া ও থানা পুলিশের অব্যাহত চাপের মুখে তারা বাড়ি ছাড়া। বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ প্রায় ৫০০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গায়েবী মামলা হয়েছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও গত ৪ দিনে বিএনপির প্রায় ৭০ জন নেতাকর্মী ও সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে বিএনপির অভিযোগ। এতকিছুর পরও বিএনপি প্রার্থী শাহ্ রিয়াজুল হান্নান মাঠ ছাড়ছেন না।
গাজীপুর-৪ কাপাসিয়া, নির্বাচনী আসনটি উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৬৭ হাজার ৩৯৪ জন। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং মুক্তিযোদ্ধের অগ্রনায়ক অন্যতম সংগঠক বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের নির্বাচনী এলাকা। তাজউদ্দীন আহমদের মেঝো কন্যা সিমিন হোসেন রিমি বর্তমানে এই আসনের এমপি।
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আসম হান্নান শাহ্। হান্নান শাহ্’র মৃত্যুর পর এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পান তার ছেলে শাহ রিয়াজুল হান্নান। এ আসনে উপজেলা বিএনপির সব পর্যায়ের নেতা শাহ্ রিয়াজুল হান্নানের নেতৃত্বে দলে পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন।
অন্যদিকে বর্তমান সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে ভোটের মাঠে দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন। বঙ্গতাজের একমাত্র পুত্র তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করলে উপনির্বাচনের মধ্যেমে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
উভয়েই পরিবারের দীর্ঘদিনের নির্বাচনী অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিজয়ের পথে হাটছেন বলে তাদের প্রত্যাশা। তৃনমূলের নেতাকর্মীদের নিয়ে চলছে শোডাউন ও প্রচার। বর্তমান সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি নিয়মিত সভা-সমাবেশ, গনসংযোগ ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করছেন। তার সমর্থকরা ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
সিমিন হোসেন রিমি বলেন, ‘আমার পিতা তাজউদ্দীন আহমদ দেশ-জাতীর জন্য জীবন দিয়ে গেছেন। আমার বিশ্বাস বিগত দিনের মত কাপাসিয়াবাসী আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে। জনগন আবার আমাকে নির্বাচিত করলে মাদকমুক্ত সমাজ ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখব’। কাপাসিয়াকে সবুজ অর্থনীতি গড়তে চান সিমিন হোসেন রিমি। কৃষিজাত পন্য উৎপাদন ও বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ তৈরীতে আরো মনোযোগ দিতে চান। গ্রামকে শহরে পরিনত করবো।
গত ২০ ডিসেম্বর কাপাসিয়ায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দলীয় প্রার্থী সিমিন হোসেন রিমির পক্ষে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেললে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ অভিযোগ করেন বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পথসভা ও গণসংযোগে হামলা করে ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বাধা সৃষ্টি করছে। তারা আওয়ামী লীগের পক্ষে গণজোয়ার দেখে বিএনপি প্রার্থী ও তার কর্মী সমর্থকরা ভয় পেয়েছে। তারা এ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে প্রতিপক্ষ বিএনপি নানা পায়তারা করছে বলেও অভিযোগ করেছে আওয়ামী লীগ।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাপাসিয়ার আড়াল বাজারে বিএনপি প্রার্থী শাহ্ রিয়াজুল হান্নানের উপর হামলার ঘটনাটি একটি বিচ্ছিন্ন দুঃখজনক ঘটনা। আমরা যতদূর জানতে পেরেছি এটা তাদের দলীয় কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ।
অপরদিকে প্রয়াত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আ স ম হান্নান শাহর মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরি শাহ্ রিয়াজুল হান্নান রিয়াজের নেতৃত্বে দলের নেতাকর্মীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। স্থানীয় নবীন ও প্রবীণ নেতাকমীরা হামলা মামলায় জর্জরিত হয়ে প্রতিকূল পরিবেশেও দলীয় কর্মকান্ডে একাট্টা। হান্নান শাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র শাহ্ রিয়াজুল হান্নান হাল ধরেছে। নেতা-কর্মীরা মনে করে রিয়াজ তার পিতা হান্নান শাহর প্রতিচ্ছবি। ২০০৮ সালের পর থেকে কাপাসিয়ার সব ইউনিয়নের তৃণমূল নেতারা দলীয় কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
রিয়াজুল হান্নান বলেন , নির্বাচনে লেভেল প্লেইং ফিল্ড বলতে কিছুই নেই। মামলা-হামলা আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের হুমকী-ধামকিতে আমাদের ধানের শীষের সমর্থক বেশী এমন গ্রামগুলো প্রায় পুরুষ শূণ্য হয়ে গেছে। গত চারদিনে আমাদের অন্ততঃ ৭০ জন নেতা, কর্মী ও সমর্থক গ্রেফতার হয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যেই ধানের শীষের পক্ষের ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। বর্তমানে এমন অবস্থা দাড়িয়েছে যে, ধানের শীষের পক্ষে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে নেয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। এতোকিছুর পরও বিএনপি প্রার্থী শাহ্ রিয়াজুল হান্নান মাঠ ছাড়বেন না বলে জানান।
এর আগে গত ১৭ ডিসেম্বর শাহ রিয়াজুল হান্নান উপজেলার সাফাইশ্রীস্থ নির্বাচনী অফিসে সংবাদ সম্মেলনে কাপাসিয়া থানার ওসির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে তার প্রত্যাহারের দাবী জানান। সংবাদ সম্মেললে হামলা মামলা, প্রচার কাজে বাধা, পোস্টারে আগুন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেতা-কর্মীদের হুমকী-ধমকির প্রতিবাদে লিখিত বক্তব্যে এসব অভিযোগ করেন।
শাহ্ রিয়াজুল হান্নান বলেন, সুপরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগ ও থানা পুলিশ প্রতিটি ইউনিয়নে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবী মামলা দিয়ে মাঠ ছাড়া করা এবং নির্বাচনের দিন ভোট কেন্দ্র দখল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। নেতা-কর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারছে না এবং স্বাধীনভাবে প্রচার কাজ করতে পারছে না।
তিনি গণতন্ত্র ও জনগনের ভোটাধিকার রক্ষা, অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে কাপাসিয়া থানার ওসির প্রত্যাহার এবং নির্বাচনে অংশ গ্রহনকৃত সকল প্রার্থীদের জন্য সমাজ সুযোগ সৃষ্টি করার দাবী জানান।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ডাঃ ছানাউল্লাহ, ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে। এ নির্বাচনে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের মনোনীত প্রার্থী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। এ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ওবায়দুল্লাহ নির্বাচিত হন।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএন পি থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আ স ম হান্নান শাহ আওয়ামী লীগের প্রার্থী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের সহধর্মিনী জোহরা তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনেও তিনি বিজয়ী হন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের ছোট ভাই অ্যাডভোকেট আফছার উদ্দিন আহমদ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আ স ম হান্নান শাহর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে জয়লাভ করেন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অস্টম সংসদ নির্বাচনে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের পুত্র তানজিম আহমদ সোহেল তাজ হান্নান শাহর সঙ্গে নির্বাচন করে বিজয়ী হন।
তারপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনে এ আসনে বিএনপি থেকে অর্থনীতিবিদ এম, এ আব্দুল মজিদ দাঁড়ালেও সোহেল তাজ বিজয়ী হন। তারপর সোহেল তাজ প্রথমে মন্ত্রীত্ব থেকে পরে সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করলে এ আসনে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে তার বড় বোন সিমিন হোসেন রিমি তার আপন চাচা অ্যাডভোকেট আফছার উদ্দিন আহমদের (স্বতন্ত্র প্রার্থী) সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী দশম সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধীদল বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. মিয়া মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে সিমিন হোসেন রিমি আবারও নির্বাচিত হন।
স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ৬ বার নির্বাচিত হয়। বিএনপি ৩ বার এবং একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হন। কাপাসিয়ায় বরাবরই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রার্থীর মাঝে ভোটের ব্যবধানও খুব একটা বেশী নয়। তবে বিভিন্ন কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সাধারণ ভোটারের মতামত অন্যরকম। ভোটের মাঠে সচেতন ভোটাররা মুখ খোলতে নারাজ। বাহ্যত ভোটাররাও যেন কৌশলী। এসব নীরব ভোটাররাই জয়-পরাজয় নির্ধারনে ভূমিকা রাখবেন বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। আগামী ৩০ ডিসেম্বর সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বিজয়ের শেষ হাসি কে হাসবে তার জন্য নির্বাচনের ফলাফল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির প্রার্থী মানবেন্দ্র দেব (কাস্তে), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট মোঃ নাজিম উদ্দিন শেখ (তারা), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত আলহাজ্ব মোঃ নূরুল ইসলাম সরকার (হাতপাখা), জাকের পার্টি মনোনীত প্রার্থী ডাঃ মোঃ জুয়েল কবির (গোলাপ ফুল), বাংলাদেশ ন্যাশনাল ফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ সারোয়ার-ই-কায়নাত (টেলিভিশন) নির্বাচন করছেন।
ইতোমধ্যে সকল প্রার্থীই এলাকায় সাধ্যমত তাদের গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কাপাসিয়ায় ১১৯টি ভোট কেন্দ্রে ৫২৬টি বুথে ভোট গ্রহণ করা হবে। ১ হাজার ৫২ জন পোলিং অফিসার দায়িত্ব পালন করবেন। এ আসনে এবারের মোট ভোটার ২ লক্ষ ৬৭ হাজার ৩৯৪ জন। যার মাঝে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩১ হাজার ৮৮৫ জন ও নারী ভোটার ১ লক্ষ ৩৫ হাজার ৫০৯ জন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা