সংবাদ প্রকাশের কারণেই কি খুন হলেন ফাগুন?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৬ মে ২০১৯, ১৮:৩০
জামালপুরের রেল লাইনের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় তার লাশ। তরুণ সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুনের এমন মৃত্যু নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। কী কারণে হত্যা করা হলো তাকে?
মঙ্গলবার রাতে ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন নামের তরুণ সাংবাদিকের লাশ উদ্ধার করে রেলওয়ে থানা পুলিশ। ফাগুন অনলাইন নিউজপোর্টাল প্রিয় ডটকমে কাজ করতেন। রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র ছিলেন তিনি। তার বাবা কাকন রেজা এনটিভির শেরপুর জেলা প্রতিনিধি।
ফাগুনের মাথায় আঘাতের চিহ্ন এবং গলা ফোলা ছিল। তা থেকে পুলিশের ধারণা, তাকে হয়ত গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে।
পুলিশ বলছে, মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে রেললাইনের পাশে ফাঁকা জায়গায় একটি ছেলেকে পড়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসেন গ্রামবাসী। তখনও দেহে প্রাণ ছিল। গ্রামবাসী তাকে উদ্ধার করে মাথায় পানিও দিয়েছে। কিন্তু বেশিক্ষণ বাঁচিয়ে রাখা যায়নি। মৃত্যুর আগে কিছু বলেও যেতে পারেনি ফাগুন। মাথায় আঘাতের কারণে তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তবে মৃত্যু সেই রক্তক্ষরণের কারণেই হয়েছে, নাকি গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে, সেটি পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না।
প্রিয় ডটকম ছেড়ে ঈদের পরই জাগো নিউজে যোগদানের কথা ছিল ফাগুনের। মঙ্গলবার সকালে ঢাকায় এসে জাগো নিউজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে চাকরি চূড়ান্ত করেছেন তিনি। ওই দিনই ট্রেনে করে গ্রামের বাড়ি শেরপুরে যাচ্ছিলেন। পথের মধ্যে মিলল তার লাশ। শুক্রবার এই ঘটনায় জামালপুর থানায় একটি হত্যা-মামলা হয়েছে। কাকন রেজার দুই ছেলের মধ্যে ফাগুন ছিল বড়। নিজের বড় ছেলে মেধাবী ও বিনয়ী ছিল বলে জানান কাকন রেজা।
মৃত্যুর নেপথ্যে কি সেই সংবাদ?
ফাগুনের বাবা কাকন রেজা বলেন, ‘‘প্রিয় ডটকমের ইংরেজি বিভাগে কাজ করত ফাগুন। মাঝে মধ্যে বাংলায়ও রিপোর্ট লিখত, যদিও তার পদবী ছিল সহ-সম্পাদক। কিছুদিন আগে একটি ডেভেলপার কোম্পানির বিরুদ্ধে সংবাদ লিখেছিল ফাগুন। ওই সংবাদের পর ডেভেলপার কোম্পানি তাকে হুমকি দিয়েছিল। এমনকি আপোষের প্রস্তাবও দিয়েছিল। ফাগুনকে নেপাল ভ্রমণের খরচ ও একটি আইফোন টেন কিনে দিতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু ফাগুন সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। পরে প্রিয় ডটকম কর্তৃপক্ষের মধ্যস্থতায় সমঝোতা হয়। সেখানে ডেভেলপার কোম্পানির এমডি এসে ক্ষমাও চেয়েছিলেন। এমনিতে ফাগুনের কোনো শত্রু ছিল না। তবে আমার নিজের সাংবাদিকতার কারণে কেউ আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ছেলেকে হত্যা করে থাকতে পারে। কারণ, পারিবারিক কোনো শত্রুতাও ছিল না আমার পরিবারে।’’
কী ছিল সেই রিপোর্টে? ঘটনাটিই বা কী ছিল? জানতে চাইলে প্রিয় ডটকমের সম্পাদক জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘‘ওই ঘটনা তো ৮ থেকে ১০ মাস আগের। ডেভেলপার কোম্পানির মালিক নিজে এসে ক্ষমা চেয়ে গেছেন। পরে আমরা রিপোর্টটি প্রত্যাহার করে নেই। বাংলাদেশে সবকিছুই হতে পারে। তবে ওই নিউজের কারণে এতদিন পর এসে হত্যাকাণ্ড, সেটা ঠিক আমার কেমন যেন লাগছে।
কারণ, ওই রিপোর্টের কারণে ডেভেলপার কোম্পানির কোনো জমি বাতিল হয়নি, তাদের তেমন কোনো ক্ষতিও হয়নি, তাহলে কেন তারা এমন করবে? তারপরও আমি বিষয়টি আরো ভালোভাবে খতিয়ে দেখবো?'' কোম্পানিটির নাম জানতে চাইলে স্বপন বলেন, ‘‘যেহেতু ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, তাই এই মুহূর্তে আমি তাদের নাম বলতে পারি না। যদি কখনো তাদের সংশ্লিষ্টতা আসে, তাহলে নাম বলবো।’’
কীভাবে ফাগুনের মৃত্যু?
জাগো নিউজে সাক্ষাৎকার দিয়ে মঙ্গলবারই শেরপুরে ফিরছিলেন ফাগুন। বেলা ৪টার দিকে শেরপুরগামী একটি ট্রেনে ওঠেন তিনি। তখনও বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। রাত ৮টায় সর্বশেষ কথা হয়েছে।
তখন তিনি বাবাকে জানান, ময়মনসিংহের কাছাকাছি আছেন। এরপরই ফাগুনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কোনোভাবেই ছেলের সন্ধান পাচ্ছিলেন না কাকন রেজা। বুধবার সকালে তিনি ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায় একটি জিডি করেন। পুলিশ ফাগুনের মোবাইল ফোনের অবস্থান শনাক্ত করে দেখে সর্বশেষ তার অবস্থান ছিল ময়মনসিংহের একটি গ্রামে। কিন্তু ওই জায়গায় ফাগুনের যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। পরে বুধবার সন্ধায় জামালপুরে অজ্ঞাত পরিচয় লাশের সন্ধান পাওয়ার কথা জেনে কাকন রেজা গিয়ে দেখেন সেটি তার ছেলের লাশ।
জামালপুর রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তাপস চন্দ্র পণ্ডিত বলেন, ‘‘গ্রামবাসী আমাদের খবর দেয়, জামালপুরের নুরুন্দি এলাকায় রেললাইনের পাশে এক তরুণকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে তার মৃত্যু হয়।’’
মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তাপস চন্দ্র পণ্ডিত বলেন, ‘‘লাশ দেখে মনে হচ্ছে, কয়েকভাবে তার মৃত্যু হতে পারে। প্রথমত ট্রেন থেকে কেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারে। অন্য জায়গায় হত্যার পর লাশ নুরুন্দি এলাকায় রেখে যেতে পারে। কারণ ওই এলাকাটি অনেকটাই ফাঁকা। মানুষের চলাচল অনেক কম। আর রাতের বেলায় তো কেউ ওখানে যায়ই না।’’
রেলওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ
ফাগুনের বাবা কাকন রেজা অভিযোগ করেছেন, ‘‘মঙ্গলবার রাত ১২টায় লাশ উদ্ধারের পর বুধবার দুপুরের পর থেকেই লাশটি অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে দাফনের চেষ্টা শুরু করে রেলওয়ে থানা পুলিশ। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেসটিগেশন (পিবিআই)-র বিরোধিকার কারণে তারা তা করতে পারেনি। তাদের এই তড়িঘড়ি দেখে আমার সন্দেহ হয় এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রেলওয়ে পুলিশের কোনো-না-কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে।’’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামালপুর রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি তাপস চন্দ্র পণ্ডিত বলেন, ‘‘বুধবার সকালে জামালপুর সদর হাসপাতালে লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। আমি নিজে পিবিআইকে ডেকে এনেছি ছেলেটির ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়ার জন্য। কারণ, আমরা যেসব লাশ উদ্ধার করি, তার সবগুলোর ফিঙ্গার প্রিন্ট রেখে দেই, যাতে এনআইডি সার্ভারের সঙ্গে মিলিয়ে পরে দরকার হলে পরিচয় জানা যায়। সব কার্যক্রম শেষে আমরা লাশটি আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে দেওয়ার উদ্যোগ নিই। কারণ, জামালপুর সদর হাসপাতালে লাশ সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেটরের কোনো ব্যবস্থা নেই। ২৪ ঘণ্টা গেলে লাশ ফুলে ওঠে, গন্ধ ছড়াতে থাকে। ফলে এভাবেই আমরা কাজটি করি। তারপরও বুধবার সন্ধ্যায় পিবিআই-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের কাছে আমি জানতে পারি, শেরপুরের একজন সাংবাদিকের ছেলে মিসিং আছে। তখন তার কাছ থেকে কাকন রেজার নম্বর নিয়ে আমি নিজেই তাকে ফোন করি।
তিনি ভাইবারে আমাকে ছবি পাঠাতে বলেন, আমি সেটাও পাঠিয়েছি। এরপর তিনি নিশ্চিত করেন যে লাশটি তার ছেলে। তিনি এসে লাশ শনাক্ত করেন। তার ছেলের লাশ অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করে আমাদের লাভ কী? বরং আমি নিজে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ছেলের লাশের সন্ধান দিয়েছি।’’
সাংবাদিক হত্যার বিচারে গড়িমসি
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিসহ এ পর্যন্ত কোনো সাংবাদিক হত্যারই বিচার হয়নি। এই বিচারের ক্ষেত্রে গড়িমসির অভিযোগ অনেক দিনের। একইভাবে তরুণ সাংবাদিক ফাগুনের বিচারও কি পাবে তার পরিবার?
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)-র সাধারণ সম্পাদক সাবান মাহমুদ বলেন, ‘‘যুগ যুগ ধরে সাংবাদিকরা সংবাদ প্রকাশের কারণে কখনো সরকারের, কখনো প্রভাবশালীদের রক্তচক্ষুর শিকার হয়েছেন। অনেককে জীবন দিতে হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই আমরা সরকারের গাফিলতি দেখেছি। আবার সাংবাদিকদের নেতা হিসেবে আমি বলতে পারি, আমাদের দায়ও কম নয়। আমরা হয়ত সেই ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলতে পারিনি বা সরকারকে বাধ্য করতে পারিনি। তবে যেখানে সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না, সেখানে সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে। গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয়।’’ ডয়েচে ভেলে।