২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ

দলে প্রয়োজন ছিল একজন লেগ স্পিনার

- ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বকাপ ক্রিকেট দরজায় কড়া নাড়ছে। সব ধরনের প্রস্তুতি শেষে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে ছুটছে অংশ্রগহণকারী দলগুলো। সব দলের একটাই স্বপ্ন শিরোপা জয়। সবাই কি আর তা পারে? শিরোপা জয় করার জন্যও প্রয়োজন ভালো একটি টিম। দল ঘোষণার অধ্যায় আগেই শেষ হয়েছে। এখন শুধু মাঠে-ময়দানের লড়াইয়ের অপেক্ষায়।

মনে বড় আশা আর শিরোপা জয়ের স্বপ্নে এরমধ্যে বাংলাদেশ দলও দেশ ছেড়েছে ক্রিকেটের বড় মঞ্চে নিজেদের প্রমাণ করতে।

স্বপ্ন দেখা সুন্দর, স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করে। সেই স্বপ্ন যদি হয় বিশ্বকাপ জয়, তবে তার জন্য প্রয়োজন হয় একটি বিশ্ব সেরা দলও। একটি সেরা দল হতে হলে, সব বিভাগে থাকতে হয় প্রয়োজন মতো মিশালি। টপ অর্ডার, মিডল অর্ডার, ফিনিশার, লেয়ার অর্ডার, অলরাউন্ডার, স্পিনার ও পেসার সব ক্ষেত্রেই দক্ষ খেলোয়াড় অবশ্যক। অতীতে যারা ভালো কিছু করেছে সবা দলেরই এই সমন্বয়ে দল ছিল।

বাংলাদেশ সময়ের সেরা একটি ক্রিকেট দল। সম্প্রতি ক্রিকেটে যে বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে এ নিয়ে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই। টানা দু’বার এশিয়া কাপের ফাইনাল, আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল এবং আইসিসির ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা তো সেটাই প্রমাণ করে। কিন্তু একটি বিষয়ে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। আর সেটা হলো এই দলে দক্ষ লেগ স্পিনারের অভাব।

রশিদ খান, শাদাব খান, ইমরান তাহির ও যুজবেন্দ্র চাহালের মতো লেগ স্পিনাররা যেখানে ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করছেন, সেখানে টাইগারদের নিয়মিত লেগ স্পিনার ক্রিকেটার নেই বললেই চলে।

সবচেয়ে বড় আসরে মাঠার নামার আগেই জায়গাটি নিয়ে অনেক আগে থেকেই ভাবা দরকার ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের। ইংল্যান্ডের মাটি হচ্ছে পেস বোলারদের জন্য স্বর্গ। কিন্তু সেই স্বর্গেও স্পিনে ফুল ফোটে। এর বড় উদাহরণ আইসিসি চ্যাম্পয়িন্স ট্রফরি র্সবশষে আসরটি। পাকিস্তানের ট্রফি জয়ের পিছনে শাদাব খানের বোলিং কারিশমা দেখছে বিশ্ব। রশিদ খানের ঘূর্ণি দেখেছে। দেখেছে আদিল রশিদের গুগলি। এবারও তার রয়েছেন বিশ্বকাপ মাতাতে।

ইংল্যান্ড ও ওয়েলস বিশ্বকাপে ভালো মানের একজন লেগ স্পিনার যদি টাইগারদের দলে থাকতো, যিনি পিচে বল টার্ণ করতে পারবেন। গুগলি দিয়ে ব্যাটসম্যানদের বোকা বানাতে পারবেন। আর্ম বল করে ব্যাটসম্যানদের চাপে ফেলতে পারবেন। পেস ভেরিয়েশন দিয়ে কাবু করতে পারবেন। এমন একজন স্পিনারের খুবই দরকার ছিল দলে। থাকলে দলটি পরিপূর্ণতা পেতো।

বিশ্বকাপের এই আসরেও লেগিদের থাকছে আধিপত্য। পাকিস্তান দলে রয়েছেন শাদাব খান, অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাডাম জাম্পা , দক্ষিণ আফ্র্রিকা দলে রয়েছেন দুইজন লেগ স্পিনার ইমরান তাহির ও তাবরিজ শামসি, নিউজিল্যান্ডে আছেন ইশ সোদি, ওয়েস্ট ইন্ডিজে অ্যাসলি নার্স, ভারতীয় যুবেন্দ্র চাহাল, ইংল্যান্ডে আদিল রশিদ, শ্রীলঙ্কায় নুয়ান প্রদীপ, জীবন মেন্ডিস ও আফগানিস্তান দলে রয়েছেন রশিদ খান। শুধু বাংলাদেশই এর ব্যাতিক্রম। বিশ্বকাপে অংশ নেয়া সব দল স্পিন বিভাগ সাজিয়েছে লেগ স্পিনার সামনে রেখে।

আইসিসির টি-টোয়েন্টি বোলিং র‌্যাঙ্কিংয়ে একটু চোখ রাখলেই দেখা যাবে ক্রিকেটে লেগ স্পিনারদের দাপট কেমন। টি-টোয়েন্টির শীর্ষ পাঁচ বোলারই লেগ স্পিনার। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেখানে আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারতের বোলারের নাম থাকলেও জায়গা হয়নি কোনো টাইগার ক্রিকেটারের।

স্পিন বান্ধব পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দলে নিয়মিত কোনো লেগ স্পিনার নেই । অন্যান্য দেশের লেগ স্পিনারদের ঘূর্ণি জাদু দেখে বাংলাদেশের ক্রিকেট অঙ্গন তাই আক্ষেপই করে গেলো শুধু। আসন্ন আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯ আসরের ১৫ সদস্যের স্কোয়াডে একজন লেগ স্পিনারের অন্তর্ভুক্তি দলকে এনে দিতে পারত বৈচিত্র্য।

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস ২০ বছরের। এই দীর্ঘ সময়েও একজন আন্তর্জাতিক মানের লেগ স্পিনার তৈরী করতে পারেনি তারা। বিশ্বকাপের সবদলে যেখানে একাধিক লেগ স্পিনার থাকে, সেখানে মশাল দিয়েও একজন মানসম্মত লেগ স্পিনার খুঁজে পাওয়া যায় না বাংলাদেশে। জুবায়ের আহমেদ লিখন ও তানভির হায়দার কিছুটা আশার আলো দেখালেও তা মিলিয়ে যেতে বেশি দেরী হয়নি।

বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ হাতুরুসিংহের অভিযোগ ছিল, জুবায়ের প্র্যাক্টিসে উদাসীন ছিলেন। একজন লেগি ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করবে লাইন লেংথ নিখুঁত করবেন, নতুন নতুন বোলিং অস্ত্র যোগ করবেন ভান্ডারে। আমাদের লেগিরা সেই পথে হাঁটছেন না। তবে ভালো মানের লেগ স্পিনার গড়ে উঠতে যে পরিবেশ রয়েছে, সেই পথেও রয়েছে বাধা। ঘরোয়া দলগুলোতে বামহাতি স্পিনারদের প্রধান্য দেয়া হয় বেশি। লেগ স্পিনাররা একটু খরচে বলে সুযোগ পায় কম। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিব) থেকেও কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি একজন লেগ স্পিনার তৈরীতে।

জুবায়ের লিখন একমাত্র লেগ স্পিনার হলেও সাম্প্রতিক ফর্ম খুবই খারাপ। অথচ এই জুবায়েরকে নিয়ে প্রত্যাশা কম ছিলো না টাইগার সমর্থকদের। সম্ভাবনা তৈরি করেও হারিয়ে যেতে বসেছেন জুবায়ের হোসেন লিখন। জাতীয় দল তো দূরে থাক, ঘরোয়া লিগসহ বিপিএলের মতো আসরেও খেলার সুযোগ পাচ্ছেন না এই লেগ স্পিনার।

২০১৪ সালের অক্টোবরে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অভিষেক হয় লিখনের। এরপর ৯ মাসের ব্যবধানে ৬ টেস্ট, ৩ ওয়ানডে ও ১টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেন জুবায়ের। এরপর জাতীয় দল থেকেই নয়, ঘরোয়া ক্রিকেট থেকেও হারিয়ে যেতে বসেছেন জুবায়ের। বিপিএলের নিলামে দল পাননি লিখন। এর আগে ২০১৬ সালের বিপিএলে চিটাগং ভাইকিংস তাকে দলে নিলেও একটি ম্যাচেও খেলায়নি। গত আসরের মতো বিপিএলে এবারও দল পেলেন না। জাতীয় দল, ঘরোয়া লিগ এবং বিপিএলে উপেক্ষিত এই সম্ভাবনাময়ী ক্রিকেটার।

একজন পরিপক্ব লেগ স্পিনার পেলে যে টাইগার দলের বোলিং লাইনআপটা আরেকটু শক্তিশালী হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জুবায়ের হোসেন লিখন অনেকের কাছে পরিচিত হলেও রিশাদ হোসেনকে হয়তো চেনেন না অনেকেই। ২০১৮ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ যুবা এশিয়া কাপে কিপটে বোলিং আর প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে সহজেই বিপর্যস্ত করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন মাত্র ১৬ বছর বয়সী রংপুরের এ বিস্ময় বালক। রিশাদকে আবিষ্কার করা হয় ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত যুবাদের এশিয়া কাপে। টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে মাত্র ২ রানে হেরে শিরোপার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হলেও উপহার স্বরূপ রিশাদকে পেয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট।

এশিয়া কাপের এবারের আসরে উইকেট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিপটে বোলার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন এই উদীয়মান ক্রিকেটার। গ্রুপ পর্ব এবং সেমিফাইনাল মিলে মোট ৩০ ওভার বল করেছেন রিশাদ। ৩.৮ ইকোনমিতে দিয়েছেন মাত্র ১১৪ রান। আর ১৪.৪ রানের গড়ে একটি করে উইকেট পেয়েছেন। সেইসঙ্গে পুরো টুর্নামেন্টে ৮টি উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ৮টি মেডেন ওভার করেছেন।

এমন সম্ভাবনময়ীদের যত্ন নিতে পারলে বাংলাদেশ দলে হয়তে লেগ স্পিনের দুঃখ ঘুচতো। বিশ্বকাপ দলেও হয়তো থাকতো একজন বিশেষজ্ঞ লেগ স্পিনার। তাই আগামীর কথা মাথায় রেখে, জুবায়ের হোসেন লিখন, তানভীর হায়দার ও রিশাদ হোসেনদের মতো নবীনদের পরিচর্যা করা প্রয়োজন।


আরো সংবাদ



premium cement