২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পরিবেশগত টেকসই পানি সরবরাহ প্রকল্প

ঠিকাদারের জন্য প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত
-

ঠিকাদারের খামখেয়ালিপনা ও কাজ না করে আদালতের আশ্রয় নেয়ার কারণে গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত টেকসই পানি সরবরাহ প্রকল্পটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটি শুরুই করা যায়নি। ছয় বছর তিন মাসে যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল, সাড়ে পাঁচ বছরে তার অগ্রগতি মাত্র ২১ শতাংশ। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু না করতে পারায় সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে এখন ব্যয় বেড়েছে ৫৭ শতাংশ বা প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। বাস্তবায়নের সাথে জড়িত একজন প্রকৌশলী জানান, মূলত ভারতীয় ঠিকাদারের কারণেই প্রকল্পটি স্থবির হয়ে আছে। এখন ঠিকাদার পরিবর্তন করা হয়েছে, যার কারণে ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন করে কিছু কাজ যুক্ত করা হয়েছে প্রকল্পে। নতুন ঠিকাদারকে কাজ দিতে এ পর্যন্ত সময় ব্যয় হয়েছে সাড়ে তিন বছর।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ঢাকা মহানগরীর পুরান ঢাকা, মতিঝিল, পুরানা পল্টন, ফকিরাপুল, উত্তরা, গুলশান, বনানী, নিকুঞ্জ, খিলক্ষেত, বাড্ডাসহ সমগ্র মিরপুর ও তৎসংলগ্ন এলাকাগুলোয় দীর্ঘ দিন ধরে প্রয়োজনের তুলনায় পানি সরবরাহ অপ্রতুল। উল্লিখিত এলাকাগুলোয় পানি সরবরাহের মূল উৎস ভূ-গর্ভস্থ গভীর নলকূপগুলোর পানি উত্তোলন ক্ষমতা প্রতিদিনই হ্রাস পাচ্ছে। তা ছাড়া শীতলক্ষ্যা নদীর পানির মান প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছে। পানি পরিশোধন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে নগরবাসীর জন্য ২৪ ঘণ্টা পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পানি ব্যবহারের জন্য কয়েকটি পানি শোধনাগার নির্মাণ কার্যক্রম চলমান আছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহায়তায় ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ খাতের উন্নয়ন প্রকল্পের উপদেষ্টা ডিজাইন ও ব্যবস্থাপনা পরামর্শক ২০১১ সালে ঢাকা শহরের জন্য পানি সরবরাহ বৃদ্ধির নামে একটি সম্ভাব্যতা যাচাই করে। ওই স্টাডি প্রতিবেদনে খিলক্ষেতে দৈনিক ১০০ কোটি লিটার ক্ষমতাসম্পন্ন পানি শোধনাগার নির্মাণে সুপারিশ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত এডিবির আর্থিক সহায়তায় ওই সম্ভাব্যতা যাচাই বা সমীক্ষা প্রতিবেদনটি মট ম্যাক ডোনাল্ড লিমিটেড কোম্পানি কর্তৃক পর্যালোচনা করা হয়। ওই পর্যালোচনাকাজ চলাকালীন খিলক্ষেতের পরিবর্তে গন্ধর্বপুরে ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব জায়গাতে মেঘনা নদী থেকে পানি সরবরাহ করে প্রথমপর্যায়ে প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার ও দ্বিতীয় ফেজে ৫০ কোটি লিটার শোধনাগার নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। আর সেই সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রকল্পটি ২০১৩ সালে একনেক থেকে অনুমোদন দেয়া হয়। তখন ব্যয় ধরা হয় পাঁচ হাজার ২৪৮ কোটি ছয় লাখ টাকা; কিন্তু ঠিকাদার ও আইনি জটিলতার কারণে এই ব্যয় এখন আট হাজার ২৩১ কোটি ৬৭ লাখ টাকায় দাঁড়াচ্ছে। প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল আরো আড়াই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুনে সমাপ্ত করার জন্য ওয়াসার পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটি চলতি বছরের ডিসেম্বরে সমাপ্ত করার কথা ছিল।
প্রকল্পের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মূলত চারটি প্যাকেজের আওতায় প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে। ডিজাইন বিল্ড অপারেশন বা ডিবিও প্যাকেজের আওতায় সম্পন্ন করা হবে। তিনটি ঋণদাতা সংস্থা এডিবি, এএফডি ও ইআইবি প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। মূল প্যাকেজটি টু স্টেজ বিডিং-পদ্ধতিতে দরপত্র প্রক্রিয়া করা হয়েছে। ২০১৩ সালে প্রথমপর্যায়ে প্রাথমিক কারিগরি প্রস্তাবনা বা দরপত্র ডকুমেন্ট তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। শীর্ষ দাতা সংস্থা এডিবির গাইডলাইন অনুসরণ করে দরপত্র ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়। তিনটি ঋণদাতা সংস্থার অনাপত্তি সাপেক্ষে গত ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমপর্যায়ের আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র পত্রিকায় প্রকাশের পর বিদেশী বিভিন্ন দক্ষ দরদাতা বা ফার্ম সমসাময়িক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে দরপত্র জমাদানের সময়সীমা বৃদ্ধির আবেদন করে। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনবার দরপত্র গ্রহণের সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়।
ঘটনার বিবরণীতে জানা গেছে, প্রথমপর্যায়ে দরপত্র ২০১৫ সালের মার্চে গ্রহণ করে আগস্টে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া যায়। একই বছর সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয়পর্যায়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ পর্যায়েও প্রাথমিক কারিগরি প্রস্তাবনা দাখিলকারী রেসপন্সিভ দরদাতারা আবার বিভিন্ন যৌক্তিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে সময় বাড়ানোর আবেদন করেন। তখন আবার তিনবার সময় বাড়ানো হয়। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে কারিগরি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। চূড়ান্ত কারিগরি প্রস্তাব মূল্যায়ন করে এডিবি। নভেম্বরে অনাপত্তি পাওয়া যায়। তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের নভেম্বরে আর্থিক দরপত্র খোলা হয়। নন রেসপন্সিভ দরদাতা কারিগরি মূল্যায়ন পুনর্বিবেচনার জন্য সিপিটিইউর রিভিউ প্যানেলে আবেদন করেন। একপর্যায়ে মন্ত্রণালয় থেকে দাতা সংস্থার পরামর্শ ছাড়া পুনঃদরপত্রের জন্য সিসিজিপিতে পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে তা আবার প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। নন রেসপন্সিভ ওই দরদাতা পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করে, যার রায় বের হয় প্রায় দুই বছর পর ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়ন অনুমোদনের জন্য সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে (সিসিজিপি) প্রেরণ করা হয়। তারা ২০১৮ সালের এপ্রিলে আর্থিক প্রস্তাব অনুমোদন করে।
ওয়াসা জানায়, ২০১৮ সালের মে মাসে রেসপন্সিভ দরদাতার সাথে চুক্তি করা হয়। প্রতিটি কার্যক্রমে যথেষ্ট সময় ব্যয় হয়েছে। সর্বসাকুল্যে সময় লেগেছে এক হাজার ২৬০ দিন বা সাড়ে তিন বছর। কার্যাদেশ প্রদান শেষে নিয়মানুযায়ী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান থেকে পারফরম্যান্স গ্যারান্টি এবং অগ্রিম পারফরম্যান্স গ্যারান্টি গ্রহণের পর ঠিকাদারকে ১০ শতাংশ মোবিলাইজেশন অগ্রিম প্রদান করে তা কার্যকর করতে আরো এক বছর সময় প্রয়োজন হয়েছে। ইআইবির ঋণের টাকা ছাড় করতে ১০ মাস সময় লেগেছে। ২০১৯ সালে ১৩ মে চুক্তিটি কার্যকর হয়েছে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
প্রকল্প পরিচালক মো: মাহমুদুল ইসলামের এবং ওয়াসার ওয়েব সাইটে প্রকল্পের অগ্রগতির তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পের কাজ মূলত চারটি প্যাকেজের আওতায় প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে। গত নভেম্বর পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি ২২ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এই সময়ে এক হাজার ১৯২ কোটি ৪৩ লাখ ৪৩ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। স্টিয়ারিং কমিটিকে মার্চে দেয়া তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পের প্রধান প্যাকেজ হলো ডিজাইন বিল্ড অপারেশন (ডিবিও)। নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলার অন্তর্গত মেঘনা নদীর পাড়ে বিশনন্দী পয়েন্টে ইনটেক নির্মাণ, বিশনন্দী থেকে রূপগঞ্জ উপজেলার গন্ধর্বপুর পর্যন্ত কমবেশি ২২ কিলোমিটার টুইনপাইপ বসিয়ে কাঁচা পানি সরবরাহ লাইন নির্মাণসহ শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়ে ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব জায়গায় দৈনিক ৫০ কোটি লিটার ক্ষমতাসম্পন্ন পানি শোধনাগার নির্মাণ করা। পরিশোধিত পানি ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন লাইনের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরীর বাড্ডা, গুলশান, বনানী, উত্তরা, মিরপুর, দক্ষিণখান, উত্তরখান, মাটিকাটা এলাকায় সরবরাহ করা হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট পরামর্শক ইমতিয়াজুল হকের সাথে গতকাল প্রকল্পের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, সর্বনি¤œ দরদাতা ঠিকাদার ও আইনি জটিলতার কারণে প্রকল্পটি যথাসময়ে না করতে পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে। মেঘনা-শীতলক্ষ্যা প্যাকেজটায় টেন্ডার হওয়ার পর আইনি সমস্যায় দুই বছর বিলম্ব হয়। সর্বনি¤œ দরদাতা হিসেবে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কাজ পায়; কিন্তু পরে তারা কাজ না করে আদালতে মামলা করে। এখন দ্বিতীয় সর্বনি¤œ দরদাতা হিসেবে ফ্রান্সের ঠিকাদারকে কাজ দেয়া হয়। তিনি জানান, এখানে দু’ধরনের ঠিকাদার রয়েছে। একটি হলো ডিজাইন ঠিকাদার এবং অপরটি হলো নির্মাণকাজের ঠিকাদার।
এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম খানের সাথে গতকাল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মিটিংয়ে আছেন।


আরো সংবাদ



premium cement