০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১,
`

কোনো বাধাই আটকাতে পারেনি অদম্য রাহাতের শিক্ষাজীবন

-

‘পায়ে নয়, দুই হাতে পরিহিত দু’টি সেন্ডেল। পা দু’টি পেছন দিক দিয়ে ভাঙ্গা, ওপর দিকে উঠে আছে। ডান হাতের বগলতলায় একটি প্লাস্টিকের ফাইল। হাপুড় দিতে দিতে কলেজ অধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করল পঙ্গু এক কিশোর। নজরে পড়তেই কলেজ অধ্যক্ষ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি ভর্তি হতে এসেছ? ছেলেছি বলল, ‘হ্যাঁ স্যার, আমি ভর্তি হবো। কথাশুনে উপস্থিত অনেকেই ‘থ’। ঘটনার দৃশ্যপট নারায়ণগঞ্জ কলেজ।
কলেজের অধ্যক্ষ রুমন রেজা খবর দিলেন কলেজ স্কাউটসকে। নির্দেশ দিলেন, ‘এই ছেলেকে ভর্তির জন্য যেন পাঁচ তলায় কষ্ট করে যেতে না হয়, সব নিচ তলা থেকে ব্যবস্থা করো।’ জন্ম থেকেই পঙ্গু সদ্য এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী রাহাত (১৯)। কিন্তু পঙ্গুত্বের বাধা বেঁধে রাখতে পারেনি এই কিশোরকে। হাপুড় দিয়ে চলাচল করে পিএসসি, জেএসসি ও এসএসসি পাস করে কলেজ জীবনে পা রেখেছে এই অদম্য কিশোর রাহাত।
কথা হয় রাহাতের সাথে। আলাপাকালে সে জানায়, জন্মক্ষণেই পঙ্গুত্ব নিয়ে পৃথিবীতে আসে সে। পৈতৃক নিবাস নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বৈবাজার সর্দার বাড়ি। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে রাহাত সবার ছোট। এক শতাংশেরও কম জায়গার দু’টি রুমে বসবাস তাদের। বাবা এমদাউল্লাহ ১০ বছর ধরে অন্ধ। মা খালেদা বেগম মারা গেছেন দেড় বছর আগে।
রাহাত জানায়, জন্মের পরেই তার জন্মপঙ্গুত্ব নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে পরিবার। কিন্তু রাহাতের মা খালেদা বেগমের সঙ্কল্প ছিলÑ এই জীবনে কোথাও রাহাতকে কারো মুখাপেক্ষী হতে দেবেন না তিনি। যেই পণ সেই যাত্রা। ছয় বছর বয়সেই নানা বাধা-বিপত্তি প্রতিরোধ করে রাহাতকে ফতুল্লার শেহারচর প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেন মা। সেখানে রাহাতের পাশে দাঁড়ায় উপজেলা প্রতিবন্ধী সংস্থার কর্মকর্তা মামা লিটন। বিভিন্ন সহায়তায় পিএসসিতে জিপিএ ৪.২২ পেয়ে পাস করে রাহাত। উত্তীর্ণ হয়েই স্কুলে ভর্তি হতে গিয়ে শুরু হয় বিপত্তি। ফতুল্লা পাইলট স্কুলে ভর্তি হতে গেলে সেখানকার কর্তৃপক্ষ পঙ্গু বলে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। উপায় না পেয়ে অনেক লোকের হাত ধরে রহাত শেষ পর্যন্ত দেখা পান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমানের।
শামীম ওসমানকে সে জানায়, পঙ্গু বলে তাকে ভর্তি নিচ্ছে না স্কুল কর্তৃপক্ষ। শামীম ওসমান স্কুল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় রাহাতকে ভর্তি নিতে। শামীম ওসমানের হস্তক্ষেপে শুরু হয় রাহাতের স্কুলজীবন। রাহাতের পাশে দাঁড়ান তার আপন ফুফাতো বোন নিপা। তিনিও ছিলেন ফতুল্লা পাইলট স্কুলের শিক্ষিকা। তিনি রাহাতকে বিনা বেতনে ব্যাচে পড়ান। এর মধ্যে রাহাতের পেটে টিউমার দেখা দেয়। অসুস্থতার কারণে জেএসসিতে রাহাত ২.৬০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। এরপর এসএসসিতে ৩. ১১ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় সে।
পরিবারের কথা জানিয়ে রাহাত জানায়, বড় ভাই মো: রিফাত মালদ্বীপ প্রবাসী। তিনি পড়াশোনায় যথেষ্ট সহায়তা করেছেন। বড় বোন সায়মার বিয়ে হয়ে গেছে। তিনিও শিক্ষাজীবনে পাশে দাঁড়িয়েছেন। বাবা এমদাউল্লাহ থান কাপড়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু ১০ বছর আগে অন্ধ হয়ে যান।
রাহাত জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টের কথা উল্লেখ করে জানায়, গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি মা খালেদা বেগম মারা যান কিডনি রোগে। এক দিকে বাবা অন্ধ, অন্য দিকে মা নেই। বড় ভাই রিফাতকে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। মায়ের সেই কথা রাহাত কখনো ভুলতে পারে না। মা বলতেন, আমি মরে গেলে তোকে কে দেখবে। তুই দুয়ারে দুয়ারে ঘুরবি তা হতে দেবো না। আমার যত কষ্ট হোক তোকে পড়াশোনা করাব। মা বেঁচে থাকলে কতই না খুশি হতেন যে, আমি কলেজে ভর্তি হচ্ছি।


আরো সংবাদ



premium cement