ইন্দোনেশিয়ার লৌহমানব সুহার্তোর পতন হয়েছিল যেভাবে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৯ মে ২০১৯, ১৩:২৭
দেশ জুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ আর দাঙ্গার মুখে ১৯৯৮ সালে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন ইন্দোনেশিয়ার দীর্ঘ ৩১ বছরের প্রেসিডেন্ট সুহার্তো। ছাত্রদের বিক্ষোভে পুলিশের গুলিকে কেন্দ্র করে ক্ষোভে ফেটে পড়ে পুড়ো দেশ। শুরু হয় দাঙ্গা। এক পর্যায়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সুহার্তো।
সেসময় ৩১ বছর ধরে ক্ষমতাসীন দেশটির স্বৈরতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট সুহার্তো। চারজন সুহার্তো বিরোধী ছাত্রকে সশস্ত্র পুলিশ রাজধানী জাকার্তায় গুলি করে হত্যার জেরে এই বিক্ষোভের সূত্রপাত। বিক্ষোভরত এই ছাত্ররা চাইছিল দেশটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন।
১৯৯৮ সালের মে মাস। ভরত ইবনু রেজা তখন রাজধানী জাকার্তার বেসরকারি ত্রি-শক্তি বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্র এবং ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিবিসির অ্যালেক্স লাস্টকে তিনি বলছিলেন, সে সময় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিতি ছিলেন না।
রেজা বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ ছাত্রের জন্যই বিক্ষোভ ছিল নতুন একটা ব্যাপার। স্বভাবতই ছাত্ররা তখন বিক্ষোভের নামে উত্তেজিত হতো। আমরা বলতাম- এই বিক্ষোভ হচ্ছে - চল্ চল্ রাস্তায় নামি।
১৯৯৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার অবস্থা তখন বেশ খারাপ। এশিয়ার অর্থনৈতিক বাজারে যে ধস নেমেছিল তার ঢেউ তখন যেভাবে এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে তার ফলে ভেঙে পড়েছে ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি।
জনসাধারণের রোষ গিয়ে পড়েছে দেশটির প্রেসিডেন্ট সুহার্তোর ওপর। স্বৈরশাসক সুহার্তো তখন তিরিশ বছরের বেশি ক্ষমতায়। বিক্ষোভ বেআইনি ঘোষণা করা হলেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় তখন প্রতিবাদ বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছে।
এই পরিবেশের মধ্যেই শীর্ষস্থানীয় ত্রি-শক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেন এবং নিজেরাই বিক্ষোভ সংগঠনের উদ্যোগ নেন।
ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তখন বেশিরভাগই ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের বড় বড় সদস্যদের ছেলেমেয়ে। তারা শুধু সংস্কারের জন্য আন্দোলনে নামেন নি- তারা চাইছিলেন বিপ্লব। হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাজপথে নামলেন- মিছিল করে এগুতে লাগলেন পার্লামেন্ট ভবনের দিকে। তাদের পথ অবরোধ করা হল। রাজপথে অবস্থান নিলেন তারা- তাদের অবস্থান বিক্ষোভে শহর থেকে শহরের বাইরে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেল।
‘আমরা সেখানে বক্তৃতা দিতাম- গান গাইতাম- গানের মধ্যে আমাদের বক্তব্য ছিল - আমরা এখান থেকে সরব না- বড় গাছ যেমন উপড়ে ফেলা যায় না- আমাদেরও তেমনি উপড়ানো যাবেনা,’ বলছিলেন ভরত ইবনু রেজা।
কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনী শক্তি ব্যবহারের কঠোর সিদ্ধান্ত নিল। বিকেল ৫টা নাগাদ অনেক শিক্ষার্থী যখন ক্যাম্পাসে ফিরতে শুরু করেছে ঠিক তখনই মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষার্থী সাদা পোশাকের এক ব্যক্তির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল হাতাহাতিতে। ওই ব্যক্তি তখন ছুটে গেছে পুলিশ লাইনের দিকে - আর পুলিশও তাদের দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করেছে।
রেজা জানান, ‘পুলিশ কমাণ্ডার বলে- তৈরি হও। দাঙ্গা পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়ানো বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বলেছিল- স্যার মারবেন না- গুলি করবেন না- আমরা ক্যাম্পাসে ফিরে যাচ্ছি; কিন্তু দাঙ্গা পুলিশ শোনেনি- তারা বন্দুকে গুলি ভরেছিল। আমরা আবার অনুরোধ করেছিলাম। তারপরই দৌড় দিই ক্যাম্পাসের দিকে। আর তখনই পালানোর সময় আমাদের উপর গুলি ছুঁড়তে শুরু করে পুলিশ।’
শিক্ষার্থীরা প্রাণভয়ে ছুটতে শুরু করলে, পুলিশ প্রথমে আকাশে ফাঁকা গুলি চালায়; কিন্তু পরমুহূর্তেই বন্দুকের নল নামিয়ে গুলি চালাতে থাকে ছুটতে থাকা শিক্ষার্থীদের উপর।
‘আমরা তখন উদভ্রান্তের মত ছুটছি- ছড়িয়ে পড়েছি নানা দিকে- গুলি থেকে বাঁচতে কেউ লুকিয়েছে গাড়ির পেছনে, কেউ দেয়ালের আড়ালে- কেউ চেচাঁচ্ছে- কেউ কাঁদছে- বিশেষ করে মেয়েরা- কারণ তারা রীতিমত ভয় পেয়ে গেছে।’
ভরত ইবনু রেজা তখন ছিলেন ক্যাম্পাসের ফটকের মুখে। অন্য শিক্ষার্থীদের ভেতরে ঢুকতে তিনি সাহায্য করছিলেন।
বলেন, ‘আমার মনে আছে কয়েকটা বুলেট এসে লাগল আমাদের ফটকের গায়ে। জীবনে সেই প্রথমবারের মত আমি মৃত্যুভয় পেয়েছিলাম- মনে হয়েছিল এই শেষ; কিন্তু কয়েক মুহূর্ত- কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কোথা থেকে যেন সাহস পেয়ে গেলাম। আমি নড়লাম না। পুলিশ যারা গুলি করছিল- তাদের দিকে চেয়ে রইলাম।’
রেজা বলেন, তার বন্ধুরা পরে তাকে বলেছিল- তিনি গুলির মধ্যে দিয়ে এমনভাবে অবলীলায় হেঁটে গিয়েছিলেন যেন কিছুই হয়নি।
লুকিয়ে পড়া অনেক শিক্ষার্থীই আশঙ্কা করেছিলেন পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকবে।
রেজা তার মাকে ফোন করলেন। সেই সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘মা খুবই উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন। তিনি গুলির আওয়াজ শুনেছিলেন। আমি বললাম -আমি ঠিক আছি মা- বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের ভেতরে আছি আমি। আমাদের জন্য দোয়া কোরো।’
বেশ কিছু শিক্ষার্থীর গায়ে গুলি লেগেছিল। ভরত রেজা ক্যাম্পাসের রেডিও স্টেশনে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন । সেখানে গুরুতর আহত একজন ছাত্রকে নিয়ে আসা হল।
‘আমি তাকে আগে চিনতাম না। ওর নাম শুনলাম - হেনরি ওয়েন-সি। রেডিও স্টেশনের ভিতর দেখলাম তার ঘাড়ের কাছ থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। খুব দ্রুত বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছিল ছেলেটি। ও মারা যাচ্ছিল। তার চোখের ভেতরটা সাদা হয়ে গিয়েছিল- মনে হচ্ছিল ওর চোখের মণি নেই।’
‘ওর একজন বন্ধু ওর ওয়ালেটটা আমার হাতে দিয়ে বলল - এটা কিছুক্ষণ তোমার জিম্মায় রাখো। ওর বন্ধুরা আহত অবস্থায় ওকে ভেতরে নিয়ে এসেছিল, কিন্তু হাসপাতালে নেয়ার আগেই ও মারা গেল।’
সেদিন গুলিতে মারা গিয়েছিল চারজন শিক্ষার্থী।
‘হেনরিকে যখন কবর দিল, আমি সেখানে গিয়েছিলাম। কবরস্থানে ওর ওয়ালেটটা আমি ওর মার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। ওর মা খুব কাঁদছিলেন- আর মূর্চ্ছা যাচ্ছিলেন।’
শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ রক্তাক্ত মৃত্যুর ঘটনায় মোড় নেবার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের মানুষও তাদের আন্দোলনের সমর্থনে পথে নামল। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠল জনতা- ক্ষোভে ফেটে পড়ল মানুষ ।
জাকার্তার বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরীহ শিক্ষার্থীদের উপর গুলি চালানোর ঘটনার নিন্দায় সরব হল। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে মুখ খুলল তারা।
সে রাতেই এক চীনা দোকানের ওপর হামলা চালায় ক্রুদ্ধ মানুষ- দোকানের পণ্য তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। জাকার্তার চীনা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। জনতা বেশ কিছু দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের খবর অনুযায়ী, সে রাতেই চীনা পাড়ায় দোকানের ভেতর অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারায় নয়জন দোকানি। বিশ কোটি মানুষের দেশ ইন্দোনেশিয়ায় শুরু হয় ব্যাপক নৈরাজ্য। একদিকে অব্যাহত ছাত্র বিক্ষোভ, অন্যদিকে উচ্ছৃঙ্খল জনতার ভাঙচুর ও লুটতরাজের কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়ে সুহার্তোর সরকার।
তিনদিনের দাঙ্গায় প্রাণ হারায় প্রায় হাজার খানেক মানুষ। এক সপ্তাহ থেকে দশদিনের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট সুহার্তো।
ভরত ইবনে রেজা বলছেন, প্রেসিডেন্ট সুহার্তো পদত্যাগের ঘোষণা দেবার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে ফেটে পড়েন তারা। ‘আনন্দে কাঁদতে থাকি আমরা।’
কিন্তু বর্তমানে মানবাধিকার কর্মী ভরত ইবনে রেজা জানান, প্রেসিডেন্ট সুহার্তো ক্ষমতা ছাড়ার পর দেশশাসনের দায়িত্ব নেয় যে সরকার তারাও তাদের আশা পূরণে সফল হয়নি। যে পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে তারা আন্দোলনে নেমেছিলেন সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে।
‘আমরা কখনই দাবি করি না যে আমরা যে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, তার ফলশ্রুতিতেই সুহার্তো পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের আন্দোলন ছিল ইন্দোনেশিয়ায় গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের একটা অংশ।’
তিনি মনে করেন, এটা শুধু প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছিল না, দেশের সরকারের প্রতিও তারা ছিলেন ক্ষুব্ধ ও হতাশ।
‘হেনরি ওয়ান-সির জীবনের সঙ্গে লড়াই আমি আজও ভুলিনি। আমার চোখের সামনে তার মৃত্যু আমি দেখেছি। আমরা যে গণতন্ত্র অর্জনের জন্য লড়াই করেছিলাম- ছাত্ররা তাদের রক্ত দিয়েছিল তা আজও অর্জিত হয়নি।’ সূত্র: বিবিসি