উড়োজাহাজে বার্ডহিট : আতঙ্কে কন্ট্রোল টাওয়ার
- মনির হোসেন
- ১৯ অক্টোবর ২০১৯, ০৬:১৮
এভিয়েশন সেক্টরে সবচেয়ে আতঙ্কের নাম হচ্ছে বার্ডহিট (পাখির আঘাত)। উড়োজাহাজ উড্ডয়ন এবং অবতরণের যেকোনা মুহূর্তেই এই বার্ডহিট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে উড়োজাহাজের ইঞ্জিন। পাইলট উপায় না দেখে দ্রুত আশপাশের বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করানো নতুবা আগের স্থানে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এরপরও বড় ধরনের বিপদ ঘটার আশঙ্কা থেকে যায় বলে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। দেশের বিমানবন্দরগুলোতে উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় উড়োজাহাজগুলো প্রায়ই বার্ডহিটের শিকার হচ্ছে। ফলে বার্ডশুটারদের যথাযথ দায়িত্ব পালন নিয়ে নানা প্রশের সৃষ্টি হয়েছে।
সর্বশেষ গত ১৪ অক্টোবর সোমবার সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সিঙ্গাপুরগামী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নতুন প্রজন্মের একটি অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ (বোয়িং-৭৩৭-৮০০) ময়ূরপঙ্খী আকাশে ওড়ার পরই পাখির আঘাতের (বার্ডহিট) শিকার হয়। ওই ফ্লাইটের দক্ষ পাইলট বিষয়টি টের পেয়ে দ্রুত গন্তব্যে না গিয়ে টাওয়ারের সহায়তায় ঢাকায় জরুরি অবতরণ করান। এরপর মেরামতের জন্য এয়ারক্রাফটটি হ্যাংগারে নেয়া হয়।
শুধু এক দিন নয়, প্রায় সময়ই বিমানবন্দরে উড্ডয়ন এবং অবতরণের সময় ছোট-বড় এয়ারক্রাফট পাখির আঘাতের শিকার হচ্ছে। তবে বিমানবন্দর থেকে পাখি তাড়ানোর জন্য সিভিল এভিয়েশন অথরিটির পক্ষ থেকে প্রতিদিন পালা করে বিমানবন্দর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা (সেটো) এক কর্মকর্তার নেতৃত্বে বার্ডশুটাররা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ সময় কর্তব্যরত বার্ডশুটাররা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করায় রানওয়ের আকাশে ও আশপাশে চিল, পেঁচাসহ নানা জাতের পাখির উৎপাত দিন দিন বাড়ছে। উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণের মুহূর্তে এগুলোতে কখনো কখনো পাখি ঢুকে পড়ছে। তবে গত কয়েক মাসে পাখির আঘাতে যে ক’টি এয়ারক্রাফট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো উড্ডয়নের মুহূর্তে ঘটেছে বলে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের স্টেশন এয়ার কন্ট্রোল টাফিক অফিসার এস এম ওয়াহিদুর রহমানের সাথে গতকাল যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, উড়োজাহাজে যে পাখি ঢুকে পড়ছে তার মধ্যে চিল, পেঁচাসহ বিভিন্ন ধরনের পাখি রয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের বার্ডশুটাররা কোনো দিন দুটি, কোনো দিন তিন-চারটি আবার কোনো দিন ১০-১২টি পাখিও মারছে। বার্ডশুটাররা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব কথা আপনাদের কে বলে? এরপর তিনি জরুরি কাজের কথা বলে টেলিফোন রেখে দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এয়ারক্রাফট (এজেডব্লিও-ড্যাশ-৮) চট্টগ্রামের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করার পরই বার্ডহিট করে। পরে পাইলট সেটি দ্রুত ঢাকায় অবতরণ করান। একইভাবে ৫ অক্টোবর বিমানের নিজস্ব বোয়িং (এইডব্লিও-৭৩৭) কুয়ালালামপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে উড্ডয়নের পরই পাখির আঘাতের শিকার হয়। সবর্শেষ ১৪ অক্টোবর সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে (এএইচভি-৭৩৭) সিঙ্গাপুরগামী উড়োজাহাজ বার্ডহিটের শিকার হয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে পাইলট উড়োজাহাজ ঢাকায় জরুরি অবতরণ করান। এ ঘটনায় জানমালের কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও যাত্রীদের সবাই ছিল উৎকণ্ঠায়। অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ (বোয়িং-৭৩৭-৮০০) ময়ূরপঙ্খীতে ১৫৬ জন যাত্রী, পাইলট ক্রুসহ মোট ১৬৩ জন ছিল।
গতকাল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রকৌশল শাখার দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, বার্ডহিট এভিয়েশন সেক্টরে একটি আতঙ্কের নাম। এয়ারক্রাফট যখন আকাশে ওড়ে তখন এর বিপরীত দিক থেকে পাখি আঘাত করে। তখন পাখি এয়ারক্রাফটের ডানায় থাকা ইঞ্জিনের ভেতরে কখনো কখনো ঢুকে পড়ে। এতে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। আবার ইঞ্জিনে আগুনও ধরে যেতে পারে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পাখি হিট করার কারণে এয়ারক্রাফট মেরামতে কমপক্ষে এক দিন আবার কখনো দুই দিনও সময় লেগে যায়। এতে এক দিকে এয়ারক্রাফট অচল হয়ে শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে অপর দিকে আর্থিক ক্ষতির মুখেও পড়তে হচ্ছে। এ ঘটনা শুধু বিমানে বা দেশীয় এয়ারক্রাফটে হচ্ছে না, বিদেশী উড়োজাহাজেও ঘটছে।
এ বিষয়ে গতরাতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র ও জনসংযোগ বিভাগের প্রধান তাহেরা খন্দকারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি টেলিফোন ধরেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বার্ডহিট আতঙ্কের কারণে সারাক্ষণ বিমানবন্দর কন্ট্রোল টাওয়ারের দায়িত্বশীলদের টেনশনে থাকতে হয়। টাওয়ার সংশ্লিষ্টরা সিভিল এভিয়েশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছে দেয়া প্রতিবেদনে বলেছেন, বার্ডহিট নিয়ে আমরাও বিপদে আছি। গতকাল সন্ধ্যার পর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক উইং কমান্ডার তৌহিদ হাসানের সাথে যোগাযোগ করা হলেও ব্যস্ত থাকার কারণে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
পরে বিমানবন্দরের ডেপুটি ডাইরেক্টর (ডিডি) বেণীমাধব বিশ্বাসের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের অভিজ্ঞ বার্ডশুটাররা রেগুলার কাজ করছে। তবে এ পদে আমাদের বার্ডশুটার আছে মাত্র দু’জন। নতুন করে বার্ডশুটার নেয়ার জন্য পরিচালক চেষ্টা করছেন। তারপরও প্রত্যেক দিন প্রটেকশন দিতে বার্ডশুটাররা ব্যবস্থা নিচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, বার্ডহিট হলে এয়ারক্রাফটের খুব বেশি ক্ষতি হয় না। পাখির আঘাতের কারণে কোনো সমস্যা হলো কি না সেটি চেক করার জন্যই জরুরি অবতরণ করানো হয়। এ ছাড়া বার্ডহিটে উড়োজাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ অথবা বড় ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কথা তার জানা নেই বলে জানান তিনি।