২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইফায় নতুন করে উত্তেজনা বোর্ডের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কর্মকর্তা বদলি ও শোকজ

ইফায় নতুন করে উত্তেজনা বোর্ডের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কর্মকর্তা বদলি ও শোকজ - ছবি : সংগৃহীত

ইসলামিক ফাউন্ডেশনে (ইফা) বোর্ডের সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রথম শ্রেণীর তিনজন কর্মকর্তাকে বদলি এবং সংস্থাটির সচিব কাজী নুরুল ইসলামসহ তিন কর্মকর্তাকে শোকজের ঘটনা ঘটেছে। ইফার মহাপরিচালক (ডিজি) সামীম মোহাম্মদ আফজাল গত রোববার থেকে মাত্র তিন দিনের মধ্যে পৃথক কয়েকটি আদেশে বদলি ও শোকজের নোটিশ জারি করেন। এ নিয়ে সংস্থাটিতে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।

ইফার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গত বৃহস্পতিবার এ ইস্যুতে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলে থানা পুলিশ কর্মকর্তা গিয়ে বৈঠক করে তাদের শান্ত করেন। তোপের মুখে অফিস করেননি ডিজি। ইফার বোর্ডের গভর্নর ও প্রশাসন সম্পর্কিত সাব কমিটির চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন আহমেদ ওই সব সিদ্ধান্তের আদেশের ওপর বাতিল লিখে স্বাক্ষর করে দেন। ডিজির বিরুদ্ধে ধর্ম মন্ত্রণালয়সহ সংস্থার সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ ‘বোর্ড অব গভর্নরস’কে অমান্য করার অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে ইফার বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য ও প্রশাসনিক কমিটির চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের নিয়োগ বদলি বা তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাজনিত কোনো ব্যবস্থা ডিজি নিতে পারেন না। গত ২২ জুন সর্বশেষ বোর্ড সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তার পরও তিনি প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাকে বদলি করেছেন। আমি সেই বদলির আদেশ বাতিল ঘোষণা করে দিয়েছি। সংস্থার সচিবসহ প্রথম শ্রেণীর অপর তিন কর্মকর্তাকে শোকজের ব্যাপারেও সিরাজ উদ্দিন বলেন, এ ধরনের শোকজের কোনো ক্ষমতা ডিজির নেই। তিনি এটি করতে পারেন না। তিনি এমন কিছু করে থাকলে সেটি কার্যকর হবে না।

এসব ব্যাপারে বোর্ডের অপর সদস্য আলহাজ মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমি যতদূর জেনেছি, একজন পরিচালক ডিজির অনুমতি না নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় একটি প্রোগ্রামে অংশ নিতে আসায় তার স্থলে আরেকজনকে ডিজি দায়িত্ব দিয়ে চিঠি ইস্যু করেছেন। বিষয়টি নিয়ে আমি ডিজির সাথে কথা বলেছি। আমি তাকে বলেছি, এ চিঠি ইস্যু করাটা ঠিক হয়নি। প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের বদলির ব্যাপারে তিনি বলেন, আসলে বোর্ডের সিদ্ধান্তে পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ব্যাপারে ডিজি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না মর্মেই আলোচনা হয়েছিল। বোর্ডের সিদ্ধান্তে আমাদেরও বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা দরকার ছিল। ইফা সচিবকে বোর্ডের সিদ্ধান্তে ফাইল ফুটআপ করার জন্য শোকজ করার ব্যাপারে মিছবাহুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আমি যেটা জেনেছি ডিজি বোর্ডের কিছু সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছেন। ডিজি দাবি করছেন, তার কাছে বোর্ডের সিদ্ধান্ত আসেনি। কিন্তু আমরা তো বোর্ডের সিদ্ধান্তের কাগজে সাথে সাথেই স্বাক্ষর করে দিয়েছি। ইফা ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজালের বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে বারবার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে গত জুন মাসে ইফা ডিজির বিরুদ্ধে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ২২ জুন অনুষ্ঠিত ইফার ২০৪তম বোর্ড সভায় সংস্থার মহাপরিচালকের কিছু ক্ষমতা খর্ব করা হয়। ওই বোর্ড সভায় ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজালও উপস্থিত ছিলেন। সে দিনের সভায় ডিজির বাকি সময় অর্থাৎ আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছুটি কাটানোর পরামর্শ দিলেও ডিজি তা না মানায় বোর্ড তার কিছু ক্ষমতা খর্ব করে তাকে বহাল রাখে। সূত্র জানায়, বোর্ড সভায় মোট আটটি সিদ্ধান্তের মধ্যে ৫ নম্বর সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ‘বোর্ড অব গভর্নরসের পূর্ব অনুমোদন ব্যতীত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সকল প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলাজনিত কোনো বিষয় সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। জরুরি প্রয়োজনে বোর্ড অব গভর্নরসের চেয়ারম্যানের সাথে আলোচনা ক্রমে মহাপরিচালক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন। তবে তা পরবর্তী বোর্ড সভায় অনুমোদন নিতে হবে।’ ওই সভায় ৩ নম্বর সিদ্ধান্তে মহাপরিচালককে ২৯ নভেম্বর ১৯৭৬ সালে বোর্ড সভা কর্তৃপক্ষের এসব ক্ষমতা প্রয়োগ সম্পর্কিত সিদ্ধান্তটি বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। ওই বোর্ড সভার পর বিষয়গুলো পত্রপত্রিকায়ও আসে। বোর্ড ডিজিকে অপসারণের সম্মানজনক বিকল্প হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মর্মে তখন বোর্ডের সদস্যরা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন।

ইফা ডিজি এরপর অফিসে অনেকটাই রুটিন দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। কিন্তু গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে হঠাৎ করে প্রথম শ্রেণীর তিনজন কর্মকর্তাকে বদলির পাশাপাশি দু’জন পরিচালক এবং খোদ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিবকে শোকজ করেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইফার সচিব কাজী নুরুল ইসলাম হজ প্রশাসনিক দলের সদস্য হিসেবে হজে যাওয়ার কারণে ইফার ফাইন্যান্স ডাইরেক্টর আফজাল উদ্দিনকে ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব দিয়ে যান। এরই মধ্যে ২২ জুনের বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে একটি ফাইল ফুটআপ করলে ডিজি এ দুই কর্মকর্তার ওপর ক্ষুব্ধ হন। তিনি গত রোববার এ দুই কর্মকর্তাকে তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিয়ে ১৩ পৃষ্ঠার একটি শোকজ জারি করেন। তাতে তিনি তাকে না জানিয়ে ফাইল ফুটআপ করা এবং ডিজির ক্ষমতার বিষয়েও ব্যাখ্যা দেন। তবে কর্মকর্তারা বিষয়টি ধর্ম মন্ত্রণালয়ে জানালে দেশের বাইরে থাকা ধর্ম প্রতিমন্ত্রী দেশে ফেরার পর বিষয়গুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে জানিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হয়। কর্মকর্তারা ওই শোকজের কোনো জবাব দেননি বলে জানা গেছে।

এ দিকে গত ১৭ আগস্ট ডিজি স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে প্রশাসন বিভাগের সহকারী পরিচালক (প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা) মুহাম্মদ মুজিব উল্লাহ ফরহাদ ও নরসিংদী কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রুহুল আমিনকে বদলি করে যথাক্রমে সমন্বয় বিভাগের উপপরিচালক এবং মহাপরিচালকের একান্ত সচিব হিসেবে বদলির আদেশ দেয়া হয় এবং পরদিন ১৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কর্মস্থলে যোগদান করতে বলা হয়। একই আদেশে নিজের একান্ত ডিজির একান্ত সচিব জাকির হোসাইনকে প্রশাসন বিভাগের সহকারী পরিচালক হিসেবে বদলির আদেশ দেন।

১৬ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত এক আদেশে চট্টগ্রাম জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ কমপ্লেক্সের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মাদ তৌহিদুল আনোয়ার গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক বোরহান উদ্দিন মো: আবু আহসানকে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ কমপ্লেক্সের পরিচালকের দায়িত্ব পালনের আদেশ দেন। একই আদেশে বলা হয় তৌহিদুল আনোয়ার কর্মস্থলে যোগদান এবং তার যোগদানপত্র গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত বোরহান উদ্দিন এই দায়িত্ব পালন করবেন। এতেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
এসব ঘটনায় গত বুধবার থেকে আগারগাঁও ইসলামিক ফাউন্ডেশনে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়। কর্মকর্তারা কাজ বন্ধ করে প্রতিবাদমুখর হলে ডিজি তড়িগড়ি অফিস ত্যাগ করেন। এ ইস্যুতে গত বৃহস্পতিবার কর্মচারীরা কর্মবিরতি পালন করে। এ সময় অঘটনের আশঙ্কায় শেরে বাংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানে আলম সেখানে গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে বৈঠক করে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে দাবি জানানোর আহ্বান জানান। ইফার বোর্ড অব গভর্নরস বদলিকৃত কর্মকর্তাদের অফিস আদেশের ওপর বাতিল লিখে স্বাক্ষর করে দেন।

সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, আগামী ৩১ ডিসেম্বর ডিজির চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তিনি শেষ মুহূর্তে এসে ইফাকে আবার অস্থিতিশীল করে পানি ঘোলা করার জন্য বোর্ডের সিদ্ধান্ত অমান্য করে এসব অফিস আদেশ জারি করে থাকতে পারেন। এ জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ডিজির অবৈধ সিদ্ধান্তে প্রতিবাদমুখর হলেও এ নিয়ে বড় কোনো বড় কোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে দিতে চান না।
ইফার বোর্ড অব গভর্নরস ও প্রশাসনিক কমিটির চেয়ারম্যানও জানিয়েছেন, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী দেশে এলে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement