হদিস মেলে না প্রকল্পের শত শত গাড়ির
প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন উপেক্ষিত- শামছুল ইসলাম
- ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:৫৮
সরকারি প্রকল্পগুলো শেষে ওই প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত গাড়িসহ অন্যান্য অনেক সরঞ্জামের খোঁজ পাওয়া যায় না। এসবের কোনো হদিসই থাকে না অনেক ক্ষেত্রে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে দীর্ঘ দিন ধরে আলোচনা-সমালোচনার পর নির্দেশনা জারি করা হলেও তা কোনো কাজে আসেনি। সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকরাও কোনো দায় নেয় না। প্রকল্প শেষ হওয়া মাত্র প্রকল্প পরিচালক অন্যত্র বদলি হয়ে চলে যান। আবার অনেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে গাড়িসহ যন্ত্রপাতি জমা না দিয়ে প্রকল্পের গাড়ি, কম্পিউটার ও ল্যাপটপ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন। প্রকল্পের মেয়াদ শেষে অনৈতিকভাবে এ গাড়ি ব্যবহারকে দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক।
বিষয়টি সরকারের শীর্ষ মহলের নজরে এলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৯ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় এ ব্যাপারে কিছু অনুশাসন দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই পিসিআর বা প্রকল্প সমাপ্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে প্রকল্পের গাড়ি, অফিস ও অন্যান্য সরঞ্জাম যথাস্থানে জমা দিতে হবে। প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে দেশেই যারা অবসরে গিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে পরামর্শক নিয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রকল্প শেষ হলে ৬০ দিনের মধ্যে সরকারি যানবাহন পরিবহন পুলে জমা দিতে হয়। কোনো কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলে ছয় মাস আগে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। কিন্তু এসব নিয়মের কোনোবালাই নেই প্রকল্পে ব্যবহৃত গাড়ি ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে। প্রকল্প শেষ হলেও বছরের পর বছর ব্যবহার করছেন কর্মকর্তারা। নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার অধীনে গত পাঁচ বছরে সহ¯্রাধিক প্রকল্প শেষ হয়েছে। ওই সব প্রকল্পের কয়েক শত গাড়ি এখনো জমা হয়নি পরিবহন পুলে। প্রকল্পের শীর্ষ কর্তাব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যরা গাড়িগুলো ব্যবহার করছেন। গাড়িচালকের বেতন ও ওভারটাইম বাবদ মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। বিধিবহির্ভূতভাবে এসবের খরচ জোগান দেয়া হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহারের সত্যতা পেয়েছে দুদক। অনুসন্ধানে নেমে প্রকল্প শেষ হওয়ার পর গাড়ি পরিবহন পুলে জমা হয়নিÑ এমন তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে প্রশাসনকে সতর্ক করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দেয়া হয়েছে। গত ১৮ জুন দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখ্ত স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়- বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের জন্য যানবাহন ও বিলাসবহুল গাড়ি কেনা হয়। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর বিধান অনুযায়ী, এসব গাড়ি পরিবহন পুলে জমা দেয়ার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা এসব গাড়ি ব্যবহার করছেন, যা দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে। এতে সরকারি যানবাহনের অপব্যবহার হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারি সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের দুর্নীতি রোধকল্পে সমাপ্তির অব্যবহিত পরে প্রকল্পের যানবাহন সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী পরিবহন পুলে জমা দিয়ে বিধিবিধান প্রতিপালন নিশ্চিত করার তাগিদ দেয়া হয়।
দুদকের ওই চিঠির পর সব মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে সতর্ক ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। গত ৯ জুলাই সব মন্ত্রণালয়ের সচিবকে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়- দুদক অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকল্পের জন্য কেনা যানবাহন প্রকল্প শেষ হওয়ার পর সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী পরিবহন পুলে জমা দেয়ার বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করে প্রকল্প শেষ হওয়ার পর গাড়ি পরিবহন পুলে জমা দেয়ার সরকারি বিধান অনুসরণ করার জন্য বলা হচ্ছে।
গত বছর বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের এক কর্মকর্তার অবৈধ দখলে থাকা একটি প্রাডো জিপ (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৩৫৫৮) উদ্ধার করে দুদক। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ডা: মাহবুবুল হক একটি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও গত ৮ মাস ধরে প্রকল্প পরিচালকের সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে আসছিলেন। ২০১৮ সালের জুন মাসে ‘হাঁস প্রজনন প্রকল্প’ নামক প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। ওই ঘটনার পর বেশ কিছু গাড়ি জমা পড়ে পরিবহন পুলে।
জানা যায়, মন্ত্রণালয়গুলোর অধীনে উন্নয়ন প্রকল্পের শেষ নেই। একটি প্রকল্প হাতে নেয়া মানেই চার থেকে পাঁচটি নতুন বিলাসবহুল গাড়ি। এসব গাড়ি সাধারণত দেড় থেকে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। অনেক সময় প্রকল্পের নামে কেনা গাড়ি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপদেষ্টা এবং সচিবরাও ব্যবহার করেন। প্রাধিকার হিসেবে পাওয়া পরিবহন পুলের গাড়ি পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করেন। এ ছাড়া কোনো প্রকল্প শেষ হলেই মন্ত্রীসহ প্রভাবশালীদের আশপাশে থাকা কর্মকর্তারা তা বাগিয়ে নেন। মন্ত্রীর বহরেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব গাড়ি ব্যবহার করা হয়।
পরিবহন পুল সূত্র মতে, প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে প্রচুর গাড়ির চাহিদা রয়েছে, কিন্তু সঙ্কট থাকায় সরবরাহ করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। প্রকল্পের গাড়ি তেমন আসে না। দু-একটি আসলে সাথে সাথে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়। সর্বশেষ গত সপ্তাহে বিসিএসআইআরের একটি এবং পদ্মা সেতু প্রকল্পের দু’টি গাড়ি জমা হয়েছে। বিভাগীয় কার্যালয়, জেলা প্রশাসক কার্যালয় ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় হতে গাড়ির চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে ২০টি জেলায় গাড়ির জন্য আবেদন জমা রয়েছে। ৪৯৩টি উপজেলার প্রতিটিতেই গাড়ি সরবরাহ প্রয়োজন। ঢাকা, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় হতে গাড়ি চাওয়া হয়েছে। কিন্তু সঙ্কটের কারণে দেয়া হচ্ছে না।
জানতে চাইলে পরিবহন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মিজানুর রহমান বলেন, প্রকল্পের গাড়ি জমা হওয়া মাত্রই আমরা অন্যত্র সরবরাহ করে থাকি। বিভিন্ন দফতরে গাড়ির চাহিদা রয়েছে। ৪৯৩টি উপজেলায় গাড়ি দরকার। আমরা ৬৬টি কিনেছি, এ বছর আরো ১০০টি কিনবো আশা করছি। প্রকল্পের গাড়ি জমা না দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জমা না দিলে আমাদের কিছু করার নেই। তবে প্রকল্পের গাড়ি জমার গতি একটু বেড়েছে। আইন অনুযায়ী- প্রকল্প শেষে গাড়ি রাখার সুযোগ নেই।
দুদক সাবেক মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রীয় সম্পদের এ অবৈধ ব্যবহার সম্পূর্ণ অনৈতিক। দুর্নীতির সমতুল্য। এটা শুধু জমা দেয়া নয়, যারা বেআইনিভাবে ব্যবহার করেছেন, জ¦ালানি ও অন্যান্য খরচ অপচয়ের অর্থ জরিমানা করে আদায় করা উচিত।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা