নুসরাত হত্যাকাণ্ড : নেপথ্য নায়কের নাম জানলে অবাক হবে যে কেউ
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ১৪ এপ্রিল ২০১৯, ০৮:১০
কারাগার থেকে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার নির্দেশেই ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পরিকল্পিতভাবে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে পুলিশকে দেয়া জবানবন্দীতে এই তথ্য জানিয়েছে হত্যা মামলার অন্যতম আসামি নূর উদ্দিন। গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনোজ কুমার মজুমদার।
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বলেন, অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদদৌলার মুক্তির জন্য ৪ এপ্রিল জেলা প্রশাসকের কাছে নূর উদ্দিন ও শামীমরা স্মারকলিপি দেয়। ওই দিনই তারা জেলখানায় গিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজের সাথে দেখা করে। সেখানে সিরাজ নূরকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমরা আমার জন্য কী করছো। আমি জেলে মরছি আর তোমরা তামাশা দ্যাখছো। যার কারণে আমি জেলে আছি, তার একটা ব্যবস্থা করো। হয় তাকে মামলা তুলে নিতে বলো না হলে তার একটা ব্যবস্থা করো। প্রয়োজনে তাকে মেরে ফেলো।’
ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এই নির্দেশের পরদিন ৫ এপ্রিল মাদরাসার পশ্চিম হোস্টেলে সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে নূর উদ্দিন, শাহাদত হোসেন শামীম, জাবেদ হোসেন, হাফেজ আব্দুল কাদের ও আরো একজনসহ মোট পাঁচজন মিলে একটি বৈঠক করে পরিকল্পনা করে। এ সময় তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে রাফিকে পুড়িয়ে মারা হবে। তারা এই সিদ্ধান্ত নেয় দুইটি কারণে। প্রথমত. নুসরাত মামলা করে অধ্যক্ষসহ আলেম সমাজকে হেয় করেছে। দ্বিতীয়ত. শাহাদত দফায় দফায় রাফিকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সে প্রত্যাখ্যান করেছে। এতে শাহাদত ক্ষিপ্ত হয়।
বৈঠকের পর তারা বিষয়টি তারা পাঁচজনের কাছে শেয়ার করে। এর মধ্যে মাদরাসার তিনজন ছাত্র ও দুইজন ছাত্রী। এই পাঁচজনের মধ্যে এক ছাত্রীর দায়িত্ব পড়ে তিনটি বোরখা ও কেরোসিন আনা। ওই মাদরাসায় পরীক্ষার আগে সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত সকালের শিফটের ক্লাস হয়। ওই ছাত্রী ৬ এপ্রিল সকাল ৮টার দিকে তিনটি বোরখা ও পলিথিন ব্যাগে ভরা কেরোসিন এনে শাহাদত হোসেন শামীমের কাছে হস্তান্তর করে। ওই সময় শামীমের সাথে আরো দুইজন ছিল। তারা হলো জোবায়ের আহম্মেদ ও জাবেদ হোসেন। সকালের শিফটের ক্লাস সকাল ৯টার দিকে শেষ হয়ে গেলে তখন একটু ফাঁকা হয় মাদরাসা। ওই সময় তারা তিনজন ও ওই ছাত্রীসহ সাইক্লোন শেল্টারের তিন তলার ছাদে অবস্থান নেয়। তিন তলার ছাদে ওই তিনজন বোরখা পড়ে নেয়। আর ছাত্রী বোরখা পরিহিত ছিল। তারা ছাদের দুইটি টয়লেটে লুকিয়ে থাকে।
পরীক্ষা শুরুর কিছু সময় আগে পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে একজন ছাত্রী যার নাম চম্পা অথবা শম্পা (গ্রেফতার রয়েছে) পরীক্ষার কক্ষে যায় নুসরাতের কাছে। সেখানে নুসরাতকে বলে যে, কারা যেন নিশাতকে ছাদে মারতেছে। এ কথা শুনে নুসরাত ছাদে যায়। এ সময় সেখানে অবস্থান নেয়া বোরখা পরিহিত চারজন নুসরাতের ওড়না দিয়ে তার হাত বেঁধে ফেলে। প্রথমে মামলা তুলে নেয়ার জন্য নুসরাতকে চাপ প্রয়োগ করা হয়। সেটি না মানলে তারা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করলেও ওই এলাকাটি অত্যন্ত নির্জন হওয়ায় অনেকে চিৎকার শুনতে পাননি।
ঘটনার পর নুসরাত নিজে ছাদ থেকে নামল কিভাবে জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান বলেন, ‘সাইক্লোন শেল্টারের ছাদ ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ওপর থেকে কেউ চিৎকার করলেও নিচে কেউ শুনতে পারবে না। আবার ছাদের দেয়ালের উচ্চতার কারণে কেউ টপকিয়ে নিচে নামতে পারবে না। ছাদ থেকে নামতে চাইলে তাকে একমাত্র সিঁড়ি দিয়েই নামতে হবে। তারা আগুন ধরিয়ে দিয়ে ছাদ থেকে নেমে মাদরাসায় অবস্থান করে। গায়ে আগুন লাগানো অবস্থায় নুসরাত সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলে অনেক মানুষ জড়ো হয়। এরপরই ওই চারজন সবার সাথে মিশে যায়।
ঘটনার দিন পরীক্ষা ছিল, অপারেশনে থাকা ছেলেমেয়েরা কিভাবে ভেতরে ঢুকলো জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান বলেন, ‘সাইক্লোন শেল্টারে সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ক্লাস হয়। এজন্য পরীক্ষার্থী ছাড়াও বাইরের অনেকেই ঢুকতে পারত। তা ছাড়া যেখানে একটি পরিকল্পিত কাজ করছিল শামীম-নূর উদ্দিনরা, তাই কে ঢুকবে বা ঢুকতে পারবে না সেই নিয়ন্ত্রণ তো তাদের হাতেই ছিল।’
নূর উদ্দিন হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে উল্লেখ করে বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এখন পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডে ১৩ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাদের সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি ছয়জনকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গ্রেফতার হওয়া নূর উদ্দিন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছে, এর আগে অনেক ঘটনা সামাল দেয়া গেছে। তাদের ধারণা ছিল, এবারের ঘটনাও সামলানো যাবে। বিশেষ করে এর আগে ২০১৭ সালের জুন মাসে নুসরাতের চোখে চুন মাখিয়ে দিয়েছিল নূর উদ্দিন। ওই ঘটনায় নুসরাত চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। ওই ঘটনাটি নূর উদ্দিন ধামাচাপা দেয়। আবার গত ২৭ মার্চের ঘটনাও একরকম ধামাচাপা পড়েছে। তাই রাফির গায়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারতে পারলেও কিছু হবে না এমনটা ভেবেই তারা কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।’
নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারার ঘটনার মামলায় আটজনের নাম উল্লেখ থাকলেও ১৩ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে বলে জানান পিবিআই প্রধান। এদের মধ্যে গ্রেফতারকৃতরা হলেন- অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদদৌলা (৫৫), নূর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর মাকসুদ আলম (৪৫), জোবায়ের আহম্মেদ (২০), জাবেদ হোসেন (১৯) ও মাদরাসার প্রভাষক আফছার উদ্দিন (৩৫)। আর এজাহারে থাকা হাফেজ আব্দুল কাদেরকে এখনো গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এজাহারের বাইরে থাকা বাকি পাঁচজনকে গ্রেফতার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’ এ ছাড়া এর বাইরেও আরো কেউ জড়িত থাকলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। যে যত বড় ক্ষমতাশালী হোক না কেন কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান পিবিআই প্রধান।
৬ এপ্রিল ঘটনার পর পিবিআই ছায়া তদন্ত শুরু করে। ৯ এপ্রিল মামলাটি পিবিআইতে আসার আগে থেকেই অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খালেদা বেগম ও রিমা সুলতানা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে সার্বক্ষণিক নুসরাতের তদারকিতে ছিলেন। যখনই সুযোগ হয়েছে তখনই একটু করে কথা বলার চেষ্টা করেছেন তারা। নুসরাত তার ভাইয়ের কাছে যে বক্তব্য দিয়েছে তা যাচাই করতে নুসরাতের সাথে কথা হয়েছে। তাতে একই বক্তব্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কথা বলার সময় মাঝে মাঝে ‘ওস্তাদ’ শব্দটা বলার চেষ্টা করেছে। পুলিশ সেই ‘ওস্তাদ’ শব্দটি যাচাই-বাছাই করছে। এরই মধ্যে পুলিশ জানতে পেরেছে যে, মাদরাসার অধ্যক্ষকে ছাত্রছাত্রীরা ‘ওস্তাদ’ বলে সম্বোধন করে। পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনার পেছনে আর কারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করা হচ্ছে। তাদের গ্রেফতার করার স্বার্থেই আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তাদের নিয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে। এ ঘটনার সাথে এমন কিছু লোক জড়িত রয়েছে যে, নাম শুনলেই অবাক হয়ে যাবে যে কেউ। গভর্নিং বডির সদস্য থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতা, শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ অনেকেই জড়িত রয়েছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা